আট ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:০৩ এএম

প্রতীকী ছবি
দেশের ব্যাংক খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আর এসব অর্থ বেরিয়েছে সংকটে থাকা ৮ ব্যাংক থেকে। এজন্য ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট দেখা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেক্ষেত্রে গ্যারান্টারের ভূমিকায় থাকবে আর্থিক খাতের এই নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। বুধবার বিকালে বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
এ সময় ডেপুটি গভর্নর ড. হাবিবুর রহমান ও নুরুন নাহারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কনফারেন্স রুমে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
তিনি বলেন, আমরা নতুন টাকা ছাপিয়ে আর কোনো ব্যাংকে তারল্য সহায়তা দেব না। কারণ, আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে গেলে এখন ২ লাখ কোটি টাকা ছাপিয়ে দিতে হবে। এতে দেশের মুদ্রাবাজার, বিদেশি মুদ্রাবাজার, মূল্যস্ফীতিসহ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এজন্য তারল্য উদ্বৃত্ত থাকা ব্যাংককে সংকটে থাকা ৮টি ব্যাংকের প্রয়োজন অনুযায়ী তারল্য সহায়তা দিতে বলেছি। যেখানে গ্যারান্টার হিসাবে কাজ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আশা করি, এটা কাজে দেবে।
তিনি বলেন, আপাতত এসব ব্যাংক কোনো ধরনের ঋণ বিতরণ করবে না। শুধু আমানতকারীদের কিছু কিছু টাকা ফেরত দেবে। তবে এতে আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই। কারণ, আমরা আমানতকারীদের অধিকার সংরক্ষণ করব। সে ক্ষেত্রে কিছুটা সময় দিতে হবে।
গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশ থেকে আট ব্যাংকের মাধ্যমে প্রচুর টাকা পাচার হয়েছে। ফলে এসব ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। আমরা সীমিত পরিসরে তারল্য সাপোর্ট দিতে চাই। সরকার আমানতকারীর কথা ভেবে তাদের পাশে দাঁড়াবে।
তিনি বলেন, এসব ব্যাংক বহুদিন ধরেই সমস্যায় ছিল। আমানতকারীরাও তা জানতেন। তারপরও বিভিন্ন লোভে আপনারা সেখানে টাকা রেখেছেন। এজন্য লুটপাট করতে সহজ হয়েছে। তবুও আমরা আমানতকারীর স্বার্থটা দেখব, যাতে তারা অর্থ ফিরে পান।
তিনি বলেন, আমরা আমানতকারীদের অনুরোধ করব আপনারা একসঙ্গে টাকা উত্তোলন করবেন না। আপনাদের প্রয়োজনমতো টাকা উত্তোলন করুন। আমাদের কিছুটা সময় দেন। আমরা আশা করি, ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াবে। একটা বিষয় পরিষ্কার করতে চাই, এই ৭ থেকে ৮টা ব্যাংকের কারণে পুরো ব্যাংক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
গভর্নর বলেন, দেশ থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রচুর টাকা পাচার হয়েছে। পাচারকারীদের দেশের মধ্যে থাকা সম্পদ উদ্ধার করব। প্রথমে আমরা এ উদ্যোগটি নেব। পাশাপাশি বাইরের দেশের পাচার হওয়া সম্পদ ফিরিয়ে আনার বিষয়েও সহায়তা চেয়েছি কয়েকটি দেশের কাছে। বাইরের টাকা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে উচ্চ আশা করব না, তবে শক্তভাবেই ধরব।
তিনি বলেন, পাচারকারীরা মূলত দুবাই, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করেছে। এজন্য আমরা প্রাথমিকভাবে এসব দেশ থেকে টাকা উদ্ধারে ব্যবস্থা নেব। বিদেশি সম্পদ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা সম্পদ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আমরা তাদের সহায়তা নেব।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, পাচারকারী একটি পরিবার ব্রিটেনে ৫০০ থেকে ৬০০ বাড়ি কিনেছে বলে শুনেছি। সে বিষয়ে আরও বিস্তর কাজ করছি। এছাড়া যারা ব্যাংক লুট করেছে, তাদের দেশে থাকা সম্পদ থেকে দায় শোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এরপর তাদের বিদেশি সম্পদে হাত দেব।
এদিকে ব্যাংক সংস্কারে ৩টি টাস্কফোর্স গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। বলেন, দেশের ব্যাংক খাত অনেকটাই ভঙ্গুর। এটা ঠিক করতে ব্যাপকভাবে কয়েক বছর পর্যন্ত কাজ করতে হবে। এটা ১-২টি ব্যাংকে সীমাবদ্ধ থাকবে না। সব ব্যাংককেই দেখব এবং কাজ করব। এজন্য একটি টাস্কফোর্স কাজ করবে। যেখানে দেশের কিছু অভিজ্ঞ লোকের পাশাপাশি বিদেশ থেকেও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের হায়ার করব। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে।
গভর্নর বলেন, আরেকটি টাস্কফোর্স বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করবে। ব্যাংক খাতের দুর্বলতার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বড় দায় রয়েছে। ওই টাস্কফোর্স বাংলাদেশ ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট, অপারেশন, রাজনৈতিক চাপ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানসহ নানা বিষয় নিয়ে কাজ করবে। এককথায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালী করতে কাজ করবে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, তৃতীয় টাস্কফোর্স হবে অ্যাসেট উত্তোলনের জন্য। অর্থাৎ খারাপ সম্পদ রিকভারির জন্য দুদক, সিআইডি, বিএফআইইউ ও আদালতসহ সব বিষয় সমন্বয় করবে। এক্ষেত্রে সরকারের কিছু কিছু নীতি পরিবর্তন বা সহায়তার প্রয়োজন পড়বে।
এদিকে দেশের মূলস্ফীতি এখনো লাগামহীন অবস্থায় রয়েছে। তবে কিছুটা স্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে। এমন পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ফের নীতি সুদহার বৃদ্ধির চিন্তা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেক্ষেত্রে চলতি মাসের শেষ সপ্তাহেই মুদ্রানীতির কমিটির সঙ্গে বৈঠকে নীতি সুদহার ফের বাড়ানো হতে পারে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারের বাইরে মৌখিকভাবে যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা রহিত করা হয়েছে। বুধবার ব্যাংকার্স সভায় বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের এই নির্দেশনা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। বৈঠকে থাকা একাধিক ব্যাংকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সূত্র বলছে, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গত মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এ মাসেও যদি বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে, তাহলে চলতি মাসের শেষদিকে মুদ্রানীতির বৈঠক করে নীতি সুদহার ফের বাড়ানো হবে। সেক্ষেত্রে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়নো হতে পারে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসা পর্যন্ত নীতি সুদহার বাড়াতে থাকবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বৈঠক শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, মুদ্রাবাজার এখন অনেকটাই স্থিতিশীল। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখনো সম্ভব হয়নি। যতদিন মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকবে, ততদিন নীতি সুদহারও বাড়বে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্র বলছে, ব্যাংকগুলোকে গত গভর্নরের আমলে সার্কুলারের বাইরে বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো এখন আর কার্যকর থাকবে না। সেক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো নিজেদের মতো করে সুদের হার নিয়ে প্রতিযোগিতা করার সুযোগ পাবে। অর্থাৎ মৌখিকভাবে বেঁধে দেওয়া ঋণের সুদহার এখন আর ১৪ শতাংশে আটকে রাখা হবে না। মার্কেট অনুযায়ী ঠিক হবে ঋণের সুদহার। তবে এ প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে কেউ যাতে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় বা অনৈতিকতার আশ্রয় না নেয়, সে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।
একই সঙ্গে আগের গভর্নরের সময়ে ক্রেডিট কার্ডের সুদহার ১৮ শতাংশের বেশি যাতে না যায়, সে মৌখিক নির্দেশনা ছিল। তা বাতিল করে সার্কুলার অনুযায়ী সুদহার নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বাড়বে ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার। পাশাপাশি আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে বিভিন্ন ধরনের মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন আগের গভর্নর, সেসব নির্দেশনাও তুলে নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র বলছে, সম্প্রতি বৈদেশিক মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণে ক্রলিং পেগের ব্যান্ড ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো এখন ১২০ টাকার মধ্যেই ডলার ক্রয়-বিক্রয় করতে পারছে। এই ডলার ক্রয়-বিক্রয় যেন কোনোভাবেই ১২০ টাকার ওপরে না যায়, সে বিষয়ে ব্যাংকারদের অনুরোধ করেছেন গভর্নর। যদি দর আরও বৃদ্ধির দরকার হয়, মার্কেট বিবেচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকই নির্দেশনা দেবে বলেও উলেখ করেছেন তিনি।
এছাড়া ব্যাংকার্স মিটিংয়ে ব্যাংকগুলোর খারাপ সম্পদ উত্তোলনে শীর্ষ নির্বাহীদের আরও বেশি ভূমিকার আশা করেছেন গভর্নর।
সার্বিক বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ব্যাংকার্স মিটিংয়ে অনেক বিষয়েই আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে সুদের হারের যেসব মৌখিক ক্যাব ছিল, সেগুলো আর থাকবে না। আর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত নীতি সুদহার বাড়তে থাকবে বলেও উলেখ করেছেন গভর্নর। এছাড়া ব্যাংকগুলোকে ১২০ টাকার মধ্যে ডলার ক্রয়-বিক্রয় করার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।