দীর্ঘমেয়াদে মুদ্রানীতির প্রভাব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হবে
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৫৮ পিএম
![দীর্ঘমেয়াদে মুদ্রানীতির প্রভাব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হবে](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2024/04/05/image-792768-1712336311.jpg)
সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি বা বাজারে টাকার প্রবাহ কমানোর নীতি অব্যাহত থাকলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও কমে আসবে। এতে বেসরকারি খাত প্রসারে ক্ষতি এবং নতুন বিনিয়োগ বাধাপ্রাপ্ত হবে। নতুন শিল্প স্থাপনের গতি মুখ থুবড়ে পড়বে। ফলে নতুন কর্মসংস্থানের গতি যেমন কমবে, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হবে চলমান কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলো।
ঋণের সুদের হার বৃদ্ধির ফলে শিল্প ও ব্যবসার খরচ লাগামহীনভাবে বাড়তেই থাকবে। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত রপ্তানি বাণিজ্যও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এতে ডলারের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সব মিলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের গতি হ্রাস পাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি আগামী অর্থবছরেও অব্যাহত রাখতে হবে।
এদিকে আইএমএফও বলেছে, আগামী অর্থবছরেও এ নীতি চালু রাখতে। দুই অর্থবছর ধরে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি চালুর ফলে বাজারে টাকার প্রবাহ কমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হয়েছে। আগামী অর্থবছরে এ নীতি চালু রাখলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও কম হবে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন আক্রমণ করলে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের সরবরাহ কমায় দাম বেড়ে যায়। এতে বাংলাদেশ বেশি দামে পণ্য আমদানির কারণে একদিকে ব্যয় বেড়ে যায়, অন্যদিকে দেশের বাজারে পণ্যের দামও বৃদ্ধি পায়। আমদানি করতে ডলার খরচ বেশি হওয়ায় রিজার্ভে টান পড়ে। ফলে ডলারের দামও বাড়তে থাকে। এতে আমদানি ব্যয় আরও বৃদ্ধি পায়। আমদানি পণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে দেশীয় পণ্যের দামও বাড়ে। ওই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে যেমন মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায়, তেমনি বাংলাদেশেও বাড়তে থাকে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ২০২২ সালের জুন থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ শুরু করে। পুরো ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি চলে। কিন্তু সুদের হার বেশি বাড়ায়নি। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে সংস্থাটি মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতিকে ব্যবহারের কথা বলে। অর্থাৎ সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণের মাধ্যমে সুদের হার বাড়িয়ে টাকাকে ব্যয়বহুল করে তোলে। এতে বাজারে টাকার প্রবাহ কমবে। ফলে চাহিদা কমে গিয়ে মূল্যস্ফীতির হারও কমে যাবে। এই নীতি অনুসরণ করে ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার দেশগুলো ইতোমধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কিন্তু বাংলাদেশে আসেনি। কারণ, ইউরোপ-আমেরিকার অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির মিল নেই। ওইসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদের হার বাড়িয়ে বাজারে ঋণের সুদ বাড়ানোর ইঙ্গিত দিলে দুই সপ্তাহের মধ্যে তা বেড়ে যায়। বাংলাদেশে নীতি সুদের হার বাড়িয়ে ব্যাংকগুলোকে ঋণের সুদহার বাড়ানোর ইঙ্গিত দিলে এক বছরেও তা বাড়ে না। কারণ, মুদ্রানীতির উপকরণগুলোর সঙ্গে ব্যাংকগুলোর নিবিড় সম্পর্ক নেই বা নির্ভরতা নেই। যে কারণে বাজারে নীতি সুদহার বাড়ানোর প্রভাব পড়ে না। ইউরোপ-আমেরিকায় একদিন বা এক সপ্তাহ মেয়াদি ঋণও আছে। ফলে সুদহার বাড়ানো সহজ হয়। বাংলাদেশে এসব নেই। ফলে দ্রুত সুদ বাড়ানো সম্ভব নয়।
২০২২-২৩ অর্থবছরজুড়ে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করে কয়েক দফায় নীতি সুদহার বাড়ালে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঋণের সুদহার বাড়ায়নি। কারণ ঋণের সুদ হারের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশ দিয়ে আটকে রেখেছিল। তবে ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে ছাড় দিলেও তা বেশি বাড়াতে পারেনি ব্যাংকগুলো। তবে নীতি সুদের হার বাড়ানোর ফলে ব্যাংকগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা নেওয়ার খরচ বেড়েছে। কিন্তু তারপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ধার কমেনি। কারণ, তারল্য সংকট মেটাতে ব্যাংক গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ বাড়াতে পারছে না। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকই এখন একমাত্র ভরসা। অন্যান্য দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছাড়াও টাকা ধার করার বহুমুখী উপকরণ রয়েছে। বাংলাদেশে সেটি নেই।
চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতিকে আরও কঠোর করে। এবার সুদের হারও বাড়াতে থাকে। গত দেড় বছরে নীতি সুদহার ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮ শতাংশে উঠেছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করার খরচও বেড়েছে। এতে ব্যাংকগুলো দ্বিগুণ বেশি সুদে টাকা ধার করছে। এর বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ঋণ দেওয়ার ট্রেজারি বিলের সুদহার বাড়িয়ে দ্বিগুণের বেশি করেছে। ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার ২০২২ সালের জুনে ছিল ৪-৫ শতাংশ। এখন তা বেড়ে গড়ে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশে উঠেছে। ফলে একদিকে ব্যাংকগুলো বেশি সুদে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করছে।
অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারি ট্রেজারি বিল কিনে আরও বেশি মুনাফা পাচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোর নিট হিসাবে মুনাফাই হচ্ছে বেশি। এতে অবশ্য সরকারের ঋণ গ্রহণের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ঋণের সুদহার বাড়ায় উদ্যোক্তারা বেশি সুদে ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়ছেন। কারণ, একদিকে ডলারের দাম গত প্রায় পৌনে দুই বছরে ৩২ থেকে ৪৮ শতাংশ বৃদ্ধিতে সবকিছুতেই খরচ বেড়েছে। এখন ঋণের সুদহার বাড়ায় এ খরচ আরও বাড়ছে। গত জুন পর্যন্ত শিল্প ঋণের সুদ ছিল ৮ শতাংশ। এখন তা বেড়ে ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশে উঠেছে। শিল্পপণ্য কেনার জন্য ভোক্তারা যে ঋণ নেন তার সুদ ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে এখন ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
সূত্র জানায়, ডলার সংকট, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের অনিশ্চয়তা, সুদের হার বৃদ্ধি এসব কারণে এখন উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থাকছেন। একদিকে অর্থনৈতিক মন্দায় মানুষের আয় কমেছে। অন্যদিকে পণ্যের দাম বাড়ায় বিক্রি কমেছে। ফলে উদ্যোক্তারা চালু শিল্পের নতুন ইউনিট বা আধুনিকায়ন থেকে বিরত থাকছেন। একই সঙ্গে নতুন বিনিয়োগেও এখন হাত দিচ্ছেন না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ডলার, গ্যাস, বিদ্যুতের সংকট আগে থেকেই ছিল। ফলে নতুন বিনিয়োগ হয়নি। এখন সুদের হার বৃদ্ধি তার ওপর খড়গ হিসাবে দেখা দিয়েছে। এ অবস্থা চললে বিনিয়োগ হবে না। বরং যেসব বিনিয়োগ মাঠে রয়েছে সেগুলোর অস্তিত্ব সংকটে। এছাড়া বৈশ্বিক ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা তো আছেই। এগুলোও কমবেশি বাণিজ্যে প্রভাব ফেলছে। কারণ, দেশের পোশাক রপ্তানির প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, এসব সংকটের কারণে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমে গেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারিতে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ১০০ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ৯০ কোটি ডলার। বিনিয়োগ কমেছে ১০ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ বেড়েছিল ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ কমেছে।