মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ ও তা সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি বা বাজারে টাকার প্রবাহ কমানোর নীতি আগামীতেও অনুসরণ করতে হতে পারে।
চলতি অর্থবছরের শেষ দিকে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধির ভালো পূর্বাভাস পাওয়া গেলেও তা কতটুকু স্থিতিশীল হবে তা নির্ভর করবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সহশীলতা ও উন্নতির ওপর। একইসঙ্গে ভ‚রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কম-বেশি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এর প্রভাবে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি কিছুটা শ্লথ হতে পারে।
দেশের সার্বিক হালনাগাদ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বুধবার প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ব্যাংক কোয়ার্টালি, অক্টোবর-ডিসেম্বর-২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটি প্রতি ৩ মাস পরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণের পরও মূল্যস্ফীতির হার প্রত্যাশিতমাত্রায় কমে আসেনি। সামান্য কমে আবার বাড়তে শুরু করেছে। দেশের ভেতরে জ্বালানি তেল, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিসহ সেবা খাতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা বেড়েছে। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে। ধানের বাম্পার ফলন ও শীতের সবজির প্রবাহ বাড়ায় এ খাতের মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমেছে। কিন্তু টাকার অবমূল্যায়নের কারণে মূল্যস্ফীতিতে যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে তা এখনো চলমান রয়েছে।
এছাড়া পরিবহণ, স্বাস্থ্য ও সেবা খাতের দাম বৃদ্ধির প্রভাবও পড়েছে। এসব কারণে মূল্যস্ফীতির হার এখনো সহনীয় মাত্রায় নামেনি। এ হারকে নিয়ন্ত্রণ ও সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনতে আগামীতেও সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ অব্যাহত রাখতে হতে পারে।
সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। এতে সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতির হারও বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশেও এ হার প্রায় ডাবল ডিজিটে চলে যায়। সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ও নানা পদক্ষেপের ফলে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির হার এখন কমে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ হার কমছে না। দেড় বছর ধরে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের উপরে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত অর্থবছর থেকে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করে আসছে।
চলতি অর্থবছরেও একই নীতি অনুসরণ করছে। তবে গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতিকে আরও বেশি কঠোর করা হয়েছে। এবার নীতি সুদের হার প্রায় দ্বিগুণ বাড়ানো হয়েছে। এর প্রভাবে ঋণ ও আমানতের সুদের হারও বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ট্রেজারি বিলের সুদের হার। এতে সরকারের ঋণ গ্রহণের খরচ মাত্রাতিরিক্তি বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতেও ঋণ প্রবাহ কমে খরচ কম হচ্ছে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি কমে গেছে। বেসরকারি খাতের বিকাশ কম হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির মৌলিক লক্ষ্য হওয়া উচিত মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রেখে দ্রুত উন্নয়ন করা। এতে বেকারদের কর্মসংস্থান হবে। মানুষের আয় বাড়বে। জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। দীর্ঘ সময় সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হলে এ কাজ বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে অর্থনীতির মূল লক্ষ্য অর্জিত হবে না।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং জোরদার করে পণ্যমূল্য কমানো সম্ভব। এতে মূল্যম্ফীতির হারও কমবে। মুদ্রানীতি সম্প্রসারণমুখী করে কর্মসংস্থান বাড়ানো গেলে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা বাড়লেও তা সহনীয় হয়ে ওঠবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে কৃষিতে প্রত্যাশিত ভালো ফসল, শিল্প খাতে স্থিতিশীল উৎপাদন এবং সেবা খাতে মাঝারি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ গতি জুন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। এ বৃদ্ধির সম্ভাবনা নির্ভর করবে দেশের বৈশ্বিক খাতের পরিস্থিতি সহনশীলতার ও উন্নতির ওপর। এছাড়া ভ‚রাজনৈতিক উত্তেজনার প্রভাবও কম-বেশি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আমন ও বোরো দুই মৌসুমেই ভালো ফলন হওয়ায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। এর সঙ্গে শীতের ফসলও ভ‚মিকা রেখেছে। খাদ্যবহিভর্‚ত মূল্যস্ফীতি বাড়ার ক্ষেত্রে জ্বালানি উপকরণের দাম বাড়ানোর প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ার কারণেও মূল্যস্ফীতিতে চাপ রয়ে গেছে।
এছাড়া স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বৃদ্ধি, আবাসন, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, এবং অন্যান্য জ্বালানি, যোগাযোগ খরচ বাড়ার কারণে খাদ্যবহিভর্‚ত মূল্যস্ফীতির হার বেশি বেড়েছে। এ হারের ঊর্ধ্বগতির কারণে এখন সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। এখনো মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। যা অনেক বেশি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রেমিট্যান্স প্রবাহে শক্তিশালী উলম্ফন ও রপ্তানি আয় বাড়ায় বৈদেশিক খাতে কিছুটা ঘাটতি কমেছে। তবে রিজার্ভ পরিস্থিতির এখনো যথেষ্ট উন্নতি হচ্ছে না।