গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি ভূমিকা রাখতে পারবে না
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:০২ পিএম
নতুন মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে খুব বেশি ভ‚মিকা রাখতে পারবে না। কারণ ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারে এখনো অস্থিতিশীলতা রয়েছে। ডলারের প্রবাহ বাড়ানো যাচ্ছে না। ঋণের সুদ হার বাড়ানোর ফলে ব্যবসা খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
গ্যাস, বিদ্যুৎ জ্বালানিও ব্যবসার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব সংকটের সমাধান না হলে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করা যাবে না। মুদ্রানীতিতে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এগুলোর প্রভাবে সংকটের সমাধান খুব একটা হবে না।
বুধবার ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) আয়োজিত মুদ্রনীতি বিষয়ক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেছেন।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে আইসিএবির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান তানভিরুর রহমান, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আশরাফ আহমেদ, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফেরদৌস আরা বেগম, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান, আইসিএবির সাবেক সভাপতি জামালুদ্দিন আহমেদ, সাবেক সভাপতি হুমায়ুন কবির ও আইসিএবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শুভাশীষ বসু। এতে সভাপতিত্ব করেন আইসিএবির সভাপতি ফোরকান উদ্দিন।
বৈঠকে বক্তারা বলেন, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় মুদ্রানীতিতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বিনিময় হার এখনো স্থিতিশীল নয়। এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যে সুযোগ ছিল, তা অনেকটা সীমিত হয়ে এসেছে। চলমান মুদ্রানীতি তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে খুব বেশি ভ‚মিকা রাখবে না।
অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ উত্তরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি রাজনৈতিকভাব শক্তিশালী উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাত মিলিয়ে দেশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বেড়েছে। যে কারণে দেশের গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতির প্রভাব যতটা তীব্র হওয়ার কথা ছিল, ততটা হয়নি। মূল্যস্ফীতি এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতির হারের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটাও হয়তো অর্জিত হবে না। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি থাকবে।
রপ্তানি আয় যেভাবে বাড়ার কথা ছিল, সেভাবে বাড়েনি। রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা খুব ভালো হয়নি। বিনিময় হার এখনো বাজারের ওপর ছাড়ার মতো অবস্থায় আছে, তা বলা যাবে না। অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় নিয়ে আসতে হলে আমদানি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে হবে। এটি এখনই সম্ভব হচ্ছে না। এসব মিলে অর্থনীতিকে যে প্রক্রিয়ায় পুনরুদ্ধারের কথা ছিল সেটি হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা আরও বাড়াতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিয়েছে। অর্থনীতিতে মুদ্রার বিনিময় হার, মূল্যস্ফীতির হার ও সুদের হার এই তিনটি বিষয় একসঙ্গে নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ ব্যাপার নয়। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় থাকে। তবে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এখানে বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য একটা শক থেরাপি দেওয়া প্রয়োজন। শক থেরাপি দিলে রপ্তানি যেমন বাড়বে, তেমনি প্রবাসী আয়েও ইতিবাচক ধারা দেখা যাবে।
তিনি আরও বলেন, এলডিসি উত্তরণের কথা বলে রপ্তানি থেকে প্রণোদনা কমিয়ে দেওয়া হলো, কিন্তু দেখা যাচ্ছে রপ্তানিকারকদের জন্য ডলারের এক দাম, আবার প্রবাসী আয় নিয়ে এলে তাকে দেওয়া হচ্ছে আরেক দাম। এটা ইতোমধ্যে বৈষম্য তৈরি করেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে তদারকি বাড়াতে হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, জাতীয় সংসদ আইন তৈরির জায়গা হলেও অর্থনীতি নিয়ে সেখান থেকে কোনো নির্দেশনা আসছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমে এলেও উচ্চ বিনিময় হারের কারণে এ সুবিধা নিতে পারছে না বাংলাদেশ। তিনি অর্থনীতিকে সঠিক পথে আনতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ঢাকার (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান তানভিরুর রহমান বলেন, অর্থের সরবরাহ কমানো হচ্ছে, কিন্তু ব্যয় কমছে না। ব্যয় বেড়েই চলেছে, তাহলে শিল্প খাত চলবে কীভাবে। জ্বালানি থেকে ভর্তুকি কমানোর কথা বলা হচ্ছে, অথচ দেশ ভর্তুকিতে অভ্যস্ত। খেলাপি ঋণ এখন অনেক সমস্যার কারণ। এই সমস্যার সমাধান কোনোভাবেই হচ্ছে না। আরেকটা বড় সমস্যা হলো, ভোগ্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেটের শক্তিশালী অবস্থান। এটা ভাঙা না গেলে নিত্যপণ্যের দাম কমবে না। মুদ্রানীতিতে এখন যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো আগে নেওয়া হলে সমস্যা এত প্রকট হতো না। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, গত কয়েক বছরে প্রবৃদ্ধির অন্যতম কারণ ছিল ডলারের প্রবাহ। ভালো প্রবাসী আয় আসছিল। কিন্তু এখন সেটা অনেক কমে এসেছে। অন্যদিকে ব্যাংক খাতে বেশ টাকাও ছিল, এখন কমে গেছে। এসব মিলিয়ে ব্যবসায়ীরা বেশ চাপে আছেন।
বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, বাজারে চার ধরনের বিনিময় হার দেখা যাচ্ছে। যারা দেশের বাইরে পড়তে যাচ্ছেন, তাদের কষ্ট করে ডলার কিনতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব ডলার ব্যাংকের বাইরে থেকে নিতে হচ্ছে, যা বাবা-মায়ের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে। জনশক্তি রপ্তানি ভালো হলেও সেভাবে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে না। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংক নানা উদ্যোগ নিলেও খেলাপি ঋণ কমছে না। যেভাবেই হোক, এটা কমাতে হবে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক খাত সংস্কারের জন্য যেসব উদ্যোগ চলমান, তা আরও জোরদার করতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান বলেন, সুশাসনের অভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির ব্যবহার দুর্বল হয়ে গেছে। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না