ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অমূল্যায়নের কারণেই এখনো মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে বড় চাপের সৃষ্টি হয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্য সরবরাহে বাধা, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের উচ্চমূল্য, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দামের ঊর্ধ্বমুখী সমন্বয় ও বাজারের অপূর্ণতা মূল্যস্ফীতির হার বাড়াতে অবদান রাখতে পারে। সম্প্রতি তৈরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, গত অক্টোবর পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হার ঊর্ধ্বমুখী ছিল। ওই মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে এ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। গত নভেম্বরে এ হার কিছুটা কমেছে। তারপরও খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ডাবল ডিজিটেই রয়ে গেছে।
নভেম্বরে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে নেমেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কমে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী মূল্যস্ফীতির হার চলতি ডিসেম্বরে আরও কিছুটা কমতে পারে। সংস্থাটি পূর্বাভাস দিয়েছে ডিসেম্বরে এ হার ৮ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শীতে সাধারণত মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমে। কারণ এ সময়ে সবজিসহ সব পণ্যের উৎপাদন বেশি হয়। এ কারণে সরবরাহ বাড়ে। ফলে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমে যায়। এছাড়া গত দুই অর্থবছর ধরে মূল্যস্ফীতির হারে লাগাম টানতে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করে টাকার প্রবাহ কমানো হচ্ছে। তবে গত জুলাই থেকে সুদহার বাড়ানোসহ টাকার প্রবাহে লাগাম টেনে ধরা হয়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করেছে।
একই সঙ্গে ডলারের দামে লাগাম টানা হয়েছে। যদিও বাজারে এর প্রভাব খুব বেশি নয়। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ডলারের দাম তিন দফায় কমানো হয়েছে। ফলে এখন ডলার বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা দামে। আগে ছিল ১১১ টাকা। ডলারের এই হিসাব ধরেই মূল্যস্ফীতির হিসাব হচ্ছে। ফলে এ হার কমছে।
কিন্তু বাস্তবে ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স কিনছে ১১৪ থেকে ১২৪ টাকা করে। এগুলো আমদানিতে বিক্রি করছে ১১৫ থেকে ১২৫ টাকা করে। এছাড়া ব্যাংকগুলো নগদ ডলার বিক্রি করছে সর্বোচ্চ ১১৬ টাকা করে। মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠানগুলোতে ডলার সর্বোচ্চ ১১৬ টাকা করে বিক্রি করার কথা থাকলেও ১২২ টাকার নিচে তাদের কাছে ডলার মিলছে না।
গত প্রায় পৌনে দুই বছর ধরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমছে বেশি মাত্রায়। ওই সময়ে ৮৫ টাকার ডলার এখন বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকায়। এ হিসাবে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩০ শতাংশ। কিন্তু ডলারের সর্বোচ্চ দর হিসাবে নিলে টাকার অমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ।
টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি পণ্যের দাম যেমন বেড়েছে, তেমনি অন্যান্য পণ্যের দামও বেড়েছে। একই সঙ্গে কমেছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। এসব কারণে মূল্যস্ফীতিতে বড় ধরনের চাপের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল ২ দশমিক ০৩ শতাংশ। রেমিট্যান্সের প্রবাহ আগামীতে কমে যেতে পারে। কারণ গত এক বছরে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেকটা সংকুচিত হয়েছে।
এছাড়া প্রবাসীদের মধ্যে একটি ধারণার জš§ হয়েছে ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরও কমবে। এ কারণে অনেকে ডলার ধরে রাখছেন। এতে রেমিট্যান্স কমতে পারে। এদিকে বিশ্বব্যাংক বলেছে, চলতি বছর শেষে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার হতে পারে।
সূত্র জানায়, সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ছে। আগে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে সীমিত ছিল। এখন তা বেড়ে সাড়ে ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এতে ব্যবসার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে পণ্যেও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে দাম বেড়ে যাচ্ছে। এতেও মূল্যস্ফীতির হারে চাপ আসবে।
এদিকে রপ্তানিতে নিæমুখিতা অব্যাহত রয়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে রপ্তানি বেড়েছিল ১১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৩০ শতাংশ। এর মধ্যে আগের স্থগিত রপ্তানি আয় এখন দেশে আসছে। ফলে নিট রপ্তানি আয় কমছে। ভূরাজনৈতিক কারণে আগামীতে রপ্তানিতে নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
গত জুলাই-নভেম্বরে রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ২৪ দশমিক ১৮ শতাংশ। এলসি খোলা বেড়েছে ১ শতাংশেরও কম। দুই বছর ধরে ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রপ্তানিতে। জানুয়ারিতে ব্যাক টু ব্যাক এলসি আরও কমতে পারে বলে পূর্ভাবাস দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এদিকে আমদানি ব্যয়ও কমছে।
গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে শুল্কভিত্তিক পণ্যের আমদানি বেড়েছিল সাড়ে ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে আমদানি কমেছে সাড়ে ২০ শতাংশের বেশি। ফলে একদিকে সরকারের রাজস্ব আয় কমছে। অন্যদিকে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কম হওয়ায় উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
চলতি মাসে আইএমএফের ঋণ বাবদ ৬৯ কোটি ডলারসহ তিনটি সংস্থার ১৩১ কোটি ডলার রিজার্ভে যোগ হওয়ায় এটি বাড়ছে। তবে জানুয়ারিতে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের দেনা শোধ করলে রিজার্ভ আবার নেমে আসবে। তবে জানুয়ারির শেষদিকে রিজার্ভ আবার কমতে পারে।
আইএমএফের আশঙ্কা আগামী জুনের মধ্যে নিট রিজার্ভ ১৭৫০ কোটি ডলারে নেমে আসতে পারে। আইএমএফ ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের শর্ত দিয়েছে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। এতে ডলারের দাম আরও বাড়তে পারে।