নোয়াবের সঙ্গে মতবিনিময়ে অর্থনীতিবিদরা
বাণিজ্যে স্যাংশন হলে বড় ধাক্কা আসবে অর্থনীতিতে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:০১ পিএম
দেশের অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছে নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব)।
রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে রোববার অনুষ্ঠিত এ সভায় সভাপতিত্ব করেন নোয়াব সভাপতি এ কে আজাদ।
অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ব্যক্তির ওপর স্যাংশন বা সংস্থার ওপর স্যাংশন এটা ওদের ব্যাপার। এটাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু বাণিজ্যের স্যাংশন অত্যন্ত বড় বিষয় বাংলাদেশের জন্য। একটাই মাত্র পণ্য। এটার ওপর নতুন বিধিনিষেধ হলে অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা আসবে।
মতবিনিময় সভায় অর্থনীতিবিদ হিসাবে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, এসওএএস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুশতাক খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ এখন বড় আলোচনার বিষয়। বাংলাদেশ ব্যাংককে বলেছিলাম, যে পর্যায়ে নেমেছে, সেটা ধরে রাখেন, আর অবনমন করতে দেবেন না। কারণ এরপরে আরও নামলে স্পেকুলেশন অনেক বেড়ে যাবে।
ব্যাংক খাত নিয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানে সবকিছু গভর্নরের ওপর দায়িত্ব দিয়ে দিলে হবে না। এখানে মূল জিনিসটা হলো সার্বিকভাবে যেটা চলছে দেশে, সেটা সুশাসন বলেন বা প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে চলছে, সেটা বলেন- এগুলো বলা প্রয়োজন। এ বিষয়গুলো ঠিক করতে না পারলে পেলিয়েটিভ ট্রিটমেন্ট দিয়ে লাভ হবে না। বাংলাদেশের সমস্যার মধ্যে প্রথমেই হলো এক্সটারনাল সমস্যা। কোভিড হচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধ। খালি বাইরের দিকে নজর দেয়া হচ্ছে। ভেতরের সমস্যা সবচেয়ে বেশি। বহিস্থ সমস্যা নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত সমস্যা। সেটা থাকবে। এর মধ্যে থেকেই ভেতরের সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছাড়া আর কোনো কম্পোনেন্ট আমরা অর্জন করতে পারিনি। অর্থাৎ তথ্যে বড় সমস্যা আছে। প্রবৃদ্ধি করতে হলে বিনিয়োগ লাগবে। পাঁচ বছরে ৩৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের লক্ষ্য থাকলেও এসেছিল ৯ বিলিয়ন ডলার। আমরা দেখছি এসব থেকে যে সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হচ্ছে সেগুলো কোনো তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে না। সে কারণে জিডিপি তো বেড়েছে, কিন্তু অনুপাত গণনায় দেখা যায় আমদানি, রপ্তানি, রাজস্ব সবগুলোর অনুপাত কমছে। অর্থাৎ মারাত্মক বড় ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে অর্থনীতি।
বিদেশি ঋণ নিয়ে বেশ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন ড. মুশতাক খান। তিনি বলেন, আপনি বিদেশি কারেন্সিতে ঋণ নিচ্ছেন কিন্তু সেটা ফেরত দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। এটা যখন হয় তখন আপনি এক পর্যায়ে গিয়ে খেলাপি হবেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাত ভবিষ্যতের জন্য বড় বোঝা হবে।
ড. মুশতাক আরও বলেন, দেশের বর্তমান ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় সমস্যা সিন্ডিকেট এবং কিছু বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ। এজন্য এখানে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না। অর্থনীতিতে এখন প্রয়োজন প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করা। সেজন্য শক্ত রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমরা জানি আমরা ব্যালান্স অব পেমেন্টের সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। আমি বলব, এটা মাঝারি বা মডারেট ক্রাইসিস। এটা পূর্ণাঙ্গ সংকটে রূপান্তরিত হয়নি। হয়তো একটু সময় লাগবে। তবে এরই মধ্যে সরকার কিছুটা পলিসি রেসপন্স করছে বা করতে বাধ্য হয়েছে। যেমন এক্সচেঞ্জ রেটের ক্ষেত্রে করতে চায়নি কিন্তু বাধ্য হয়েছে। বাজার পরিস্থিতি বাধ্য করেছে।
বর্তমান সংকটের জন্য ঋণের সুদের হার ৬-৯ কে বড়ভাবে দায়ী করে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এ কারণে আমানত প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। ব্যাংক থেকে অর্থ বের হয়ে গেছে। সেসব অর্থ আর ব্যাংকে ফিরে আসেনি।
ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, অর্থনীতির পরিস্থিতি সবার জানা। প্রশ্ন হচ্ছে উন্নয়নের গল্পটা ভবিষ্যতে জারি রাখতে পারবে নাকি পারবে না। যেমন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। দেশে বিপুল পরিমাণ খাদ্যপণ্য আমদানি হয়। কিন্তু উন্নয়ন গল্পে খ্যাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, ফলে এটা সঠিক চিত্র নয়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের যে মূল্যস্ফীতি এটা ঘটছে সরকারের নীতির কারণে। যেমন ঋণ পরিশোধ করতে টাকার দরকার হবে। তখন আরেকটা মূল্যস্ফীতি তৈরি হবে। জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকির দিকে যাচ্ছে।
মতবিনিময় সভার সূচনা বক্তব্যে নোয়াব সভাপতি এ কে আজাদ অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ প্রত্যাশা করেন। তিনি বলেন, আরও নিবিড়ভাবে বোঝার জন্য নোয়াবের এই আয়োজন। অর্থনীতির সঠিক খবর যেন সংবাদমাধ্যম তুলে ধরতে পারে সেজন্য তাদের জানা-বোঝার প্রয়োজন আছে।
নোয়াবের সদস্যদের মধ্যে মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ, করতোয়া সম্পাদক মোজাম্মেল হক, বণিক বার্তার প্রকাশক ও সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ। এ সময় নোয়াবের সদস্য বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রায় ২৫ জন সংবাদকর্মী উপস্থিত ছিলেন।