বৈশ্বিক মূল্য ব্যবস্থা বা শৃঙ্খলে (গ্লোবাল ভ্যালু চেইন) পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এছাড়া রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণ হচ্ছে না। পাশাপাশি বাংলাদেশে উচ্চ শুল্কহারের কারণে আমদানি ক্ষেত্রে বাধা রয়েছে। ফলে কোনো রপ্তানি পণ্য তৈরির ক্ষেত্রে এর কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চ শুল্ক দিতে হয়। এ কারণে উৎপাদন খরচ বেশি হচ্ছে। যার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় পিছিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ‘ট্রান্সফরমিং বাংলাদেশ পার্টিসিপেশন ইন ট্রেড অ্যান্ড গ্লোবাল ভ্যালু চেইন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। এডিবি এবং ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ইনস্টিটিউট আয়োজিত অনুষ্ঠানে রোববার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। বক্তব্য দেন এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর এডিমন গিন্টিং। আলোচক ছিলেন পিআরআই’র নির্বাহী পরিচালক জাঈদী সাত্তার এবং এডিবির রিজিওনাল অ্যাডভাইজার রানা হাসান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এডিবির চিফ ইকোনমিস্ট অ্যালবার্ট এফ পার্ক, সিনিয়র পরিসংখ্যানবিদ মাহিনথান জে মার্সিসংঘাম এবং সংস্থাটির অর্থনীতিবিদ পারমিলা এ শ্রীভেলি। সমাপনী বক্তব্য দেন ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ডিরেক্টর আরিফ সোলায়মান।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি পণ্য রপ্তানি হওয়ার আগে একটি দেশের অভ্যন্তরে কয়টি ধাপ অতিক্রম করে। তার ওপর বৈশ্বিক মূল্য শৃঙ্খলে (জিভিসি) সংশ্লিষ্ট দেশের অবস্থান নির্ভর করে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। আর গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এক্ষেত্রে বাংলাদেশে তেমন অগ্রগতি হয়নি। ২০০০ সালে একটি পণ্যের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ফরোয়ার্ড স্টেজ বা সম্মুখ ধাপ ছিল চার দশমিক ১০। অর্থাৎ কোনো পণ্য রপ্তানি হওয়ার আগে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এতগুলো ধাপ দেশে অতিক্রম করেছে। ২০২১ সালে এটি কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে ৪ দশমিক ১৫ হয়েছে। বৈশ্বিক মূল্য শৃঙ্খলে নিজেদের অবস্থান বাড়ানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসাবে ভিয়েতনামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। উৎপাদনভিত্তিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জিভিসিতে দেশটির অংশগ্রহণ ১৯ দশমিক ৩ থেকে ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ পর্যন্ত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ মাত্র ১ দশমিক ৮ থেকে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। আর এমন নিু অংশগ্রহণ দীর্ঘদিন ধরেই প্রবহমান। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না।
প্রতিবেদনটিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো, বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ না হওয়া। এমনকি যে টেক্সটাইল পণ্যে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের শক্ত অবস্থান, সেই পণ্যের ক্ষেত্রেও কোনো বৈচিত্র্য আনতে পারেনি দেশটি। যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশ গতানুগতিক পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি করছে। এছাড়া বাংলাদেশ যেসব পণ্য রপ্তানি করে সেগুলোর ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ খুবই দুর্বল। অধিকাংশ মধ্যবর্তী পণ্য ও কাঁচামাল অন্য দেশ থেকে আমদানি করে আনতে হয়। ফলে দেশের অভ্যন্তরে এসব পণ্যের মূল্য সংযোজন খুবই কম। তাই রপ্তানি কার্যক্রম দেশের অভ্যন্তরে পর্যাপ্ত সংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থের সার্কুলেশন বাড়াতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারছে না। পণ্যের বহুমুখীকরণ না হওয়ায় বাংলাদেশ ২০৩১ সালে যে উচ্চ মধ্যম আয় ও ২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, তা অর্জন করা সম্ভব হবে না।
প্রতিবেদনটির তথ্যমতে, পণ্যের বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে ভারত-পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। এমনকি উৎপাদনের বিভিন্ন খাতের ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পণ্যের বহুমুখীকরণ নিশ্চিত করতে না পারায় বাংলাদেশ পর্যাপ্ত পরিমাণ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করতে পারছে না। এক্ষেত্রে ভিয়েতনামের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, দেশটি ধীরে ধীরে কৃষি থেকে মেনুফ্যাকচারিংয়ের দিকে ধাবিত হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় প্রথমে তারা পোশাক খাতে নজর দিয়েছে। এরপর তারা ইলেকট্রনিক্স খাতে সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বড় কোনো খাত তৈরি করতে পারেনি। বাংলাদেশে আসা এফডিআইয়ের প্রায় ২০ শতাংশই আসে বস্ত্র খাতে। বিশ্বে বর্তমানে আইসিটি খাতে বড় অঙ্কের এফডিআই প্রবাহ রয়েছে। কিন্তু এ খাতে বৈশ্বিক এফডিআইয়ের এক শতাংশেরও কম পরিমাণ বাংলাদেশে আসে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. শামসুল আলম বলেন, আমরা পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় রপ্তানি বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দিয়েছি। এটি স্বীকার করতে অসুবিধা নেই যে আমাদের শুল্ক হার অনেক উচ্চ। এটি আলোচনা করে কমাতে হবে। কর আদায়ের হারও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি। সেটিও আলোচনা করতে হবে। তবে আমাদের কর জিডিপি রেশিও অনেক কম। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজস্ব ঘাটতি ৬ শতাংশ পূরণে করজাল বাড়াতে হবে। সাধারণত রাজস্ব ঘাটতি আগে কখনও ৫ শতাংশের বেশি ছিল না।
তিনি আরও বলেন, বাজেট আলোচনা শুধু এক মাস নয়, আরও দীর্ঘ সময় ধরে করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শুধু সংসদ নয়, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, সুশীল সমাজ, অর্থনীতিবিদসহ সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ানো দরকার। আমাদের শুধু বৈদেশিক অর্থ নয়, প্রযুক্তিগত সহায়তাও নিতে হবে। রপ্তানির ক্ষেত্রে পণ্য এবং বাজার উভয়ই বহুমুখীকরণ করতে হবে।
অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইএমএফ যাই বলে বলুক, আমরা আমাদের নিজেদের মতো কার্যক্রম নেব। তারা আমাদের সহযোগী হিসাবে পরামর্শ দিতেই পারে। তার উদাহরণ হলো নিজের টাকায় পদ্মা সেতু করা। আমাদের সুদ হার আপাতত বাড়ানোটা ঠিক হবে না। আমেরিকা যদিও সুদ হার বড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি কাজ নাও দিতে পারে। এক্ষেত্রে ধীরে যেতে হবে।
জাঈদী সাত্তার বলেন, অর্থনৈতিক উত্তরণে রপ্তানি বহুমুখীকরণই বড় চ্যালেঞ্জ। গ্লোবাল ভ্যালু চেইনে বাংলাদেশের অবস্থা বেশি ভালো নয়।