প্রতিবছর ৫৫ হাজার ৮০০ কোটি থেকে ২ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি এবং কৌশলে কর এড়িয়ে যাওয়া হয়। এ অর্থ বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দের ৮ গুণ এবং স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের ২০০ গুণ।
মূলত আর্থিক খাতের সমন্বয়ের অভাবে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে কৌশলে কর এড়িয়ে যাচ্ছে। এছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে পর্যাপ্ত উদ্যোগ না থাকায় সরকার বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। ক্রিশ্চিয়ান এইড ও সিপিডি যৌথভাবে ১০ জন হিসাববিদ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দুজন সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে গবেষণা প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম। এতে বলা হয়, কর অস্বচ্ছতাকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, কর ফাঁকি ও দ্বিতীয়ত, কর এড়িয়ে যাওয়া। প্রকৃত আয় কম দেখিয়ে করপোরেট প্রতিষ্ঠান কর ফাঁকি দিয়ে থাকে। অন্যদিকে আইনের মধ্যে (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক) থেকে কম কর দিয়ে এড়িয়ে যাওয়া হয়। কর ফাঁকি ও কর এড়ানোর দৃষ্টিতে ১৪১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫২তম। মোট জিডিপির ৫-২৫ শতাংশ কর কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়। আর ১৫-৮০ শতাংশ কর ফাঁকি দেওয়া হয়। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৫৫ হাজার ৮০০ কোটি থেকে ২ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। এ অর্থ আদায় করা গেলে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয় ১ হাজার ৮৬২ থেকে বাড়িয়ে ৬ হাজার ৮৪৪ টাকা এবং শিক্ষা খাতে ৪ হাজার ৬৫৬ থেকে বাড়িয়ে ৯ হাজার ৬৩৮ টাকা করা যেত।
এতে আরও বলা হয়, বিশ্বব্যাপী করপোরেট করহার কমানো হচ্ছে। অথচ দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশে বাড়ছে। করহার বেশি থাকলে রাজস্ব আদায় বাড়বে বলে ভাবা হয়। কিন্তু হচ্ছে উলটোটা। কর-জিডিপি অনুপাত দেখলে সেটি বোঝা যায়। কেবল আফগানিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত কম। আবার হার কমালেও আদায় বাড়ার নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, একাধিক স্তরবিশিষ্ট করপোরেট করহার। এ কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ফাঁকির প্রবণতা দেখা যায়।
অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি বা ছায়া অর্থনীতির আকার বাড়ছে উলেখ করে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতির ৩০ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। এ খাত করের আওতার বাইরে থাকায় রাজস্ব আয় বাড়ানো যাচ্ছে না। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা গেলে ৮৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় সম্ভব। যদিও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অর্থনীতিতে ৫২ দশমিক ৪ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অবদান হলেও সে দেশে কর-জিডিপি অনুপাত ১৮ শতাংশের বেশি।
এক্ষেত্রে ব্রাজিল উদাহরণ হতে পারে। অর্থনীতির ৩৩ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের হলেও কর-জিডিপি অনুপাত ৩২ শতাংশের বেশি। কর প্রশাসন শক্তিশালী এবং শক্তিশালী ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিংয়ের কারণে সেটি সম্ভব হয়েছে।
করজাল বৃদ্ধির মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানো সম্ভব উলেখ করে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ৬৮ শতাংশ কর দেওয়ার যোগ্য ব্যক্তি কর দেন না। যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরে (আরজেএসসি) নিবন্ধিত আড়াই লাখ কোম্পানির মধ্যে ৩০ হাজার কোম্পানি রিটার্ন জমা দেয়। অর্থাৎ পাঁচটি কোম্পানির মধ্যে মাত্র একটি কোম্পানি রিটার্ন জমা দেয়।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বড় অংশই কর দেওয়ার যোগ্য থাকলেও তারা রয়েছে কর আওতার বাইরে।এসব বিষয়ে নজর দেওয়া গেলে রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব।পাশাপাশি ব্রাজিল,আর্জেন্টিনা, মালয়েশিয়া, কেনিয়ার মতো কর ফাঁকির তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করা যেতে পারে। তাহলে সুনামের ভয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান কৌশলে কর এড়িয়ে যাওয়া থেকে বিরত থাকবে।
২০২৩-২৪ বাজেটে কর ফাঁকি এবং কৌশলে কর এড়িয়ে যাওয়া রোধে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রাখার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি। মূল প্রবন্ধে আরও বলা হয়,প্রতি অর্থবছরে কত টাকা কর ফাঁকি উদ্ঘাটন করা সম্ভব এবং কৌশলে কীভাবে এড়ানো কর আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে,সেটি বাজেট পরিকল্পনায় থাকতে হবে। একই সঙ্গে বছর শেষে করের লক্ষ্যমাত্রা কতটুকু অর্জিত হয়েছে, সেটিও বাজেটে উলেখ থাকতে হবে।
এছাড়া রাজস্ব আয় বাড়াতে অযৌক্তিক কর অব্যাহতি সুবিধা বাতিলের প্রস্তাব থাকতে পারে। কৌশলে কর এড়িয়ে যাওয়া বন্ধে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা),বাংলাদেশ ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বেজা, বেপজা ও এনবিআর-এর মধ্যে কীভাবে সমন্বয় করা হবে,সেটিও তুলে ধরতে হবে। যাতে কর নির্ধারণের সময় এসব প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের তথ্য সহজে পাওয়া যায়।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া কর ন্যায্যতা ও কর স্বচ্ছতার পরিপন্থি। এ জায়গা থেকে সরে আসা দরকার। এর পরিবর্তে নজরদারি বাড়িয়ে কালোটাকার উৎস রোধ করার মাধ্যমে, এর উৎপত্তি বন্ধের মাধ্যমে কর আদায় সম্ভব। ফলে আগামী বাজেটে সরকার কালোটাকা সাদা করার সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসবে বলে আশা করছি।
তিনি আরও বলেন, বিদ্যমান কর অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। একই খাতে দীর্ঘদিন একই ধরনের অব্যাহতি দেওয়ায় সেটি ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রণোদনা হিসাবে বিবেচিত হয় না, উদ্যোক্তারাও লাভবান হন না। এর পরিবর্তে নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক ও লক্ষ্যভিত্তিক অব্যাহতি দেওয়া যেতে পারে। পুরোনো খাতের পরিবর্তে নতুন খাত চিহ্নিত করে সেগুলোকে কর অব্যাহতি দিয়ে বিকাশে সহযোগিতা করা যেতে পারে।
সমাপনী বক্তব্যে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড.ফাহমিদা খাতুন বলেন,কর ব্যবস্থাপনা উন্নত ও আধুনিক করার মাধ্যমে রাজস্ব আয় বাড়িয়ে বাজেট ঘাটতি কমানো যেত।নিজেদের সক্ষমতা উন্নয়নে এনবিআর পদক্ষেপ নিচ্ছে; কিন্তু তা অত্যন্ত ধীরগতি। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যেসব সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল,এখন সেগুলো বাইরের চাপে আইএমএফ-এর ঋণের জন্য করতে হচ্ছে।