অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত ‘সার্কুলার অর্থনীতি’
ড. মো. মঞ্জুরে মওলা, ফিনল্যান্ড থেকে
প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২০, ০৬:৩৪ এএম
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত তথা সুখী সন্দর, সবুজ-টেকসই সমাজ গঠনে এক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে ‘সার্কুলার অর্থনীতি’। কেননা বাংলাদেশ তথা বিশ্বের ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে ব্যবহৃত যে ম্যাটেরিয়াল আছে তা ব্যবহারের মাধ্যমে সঠিক সেবা প্রদান নিশ্চিত করে, বর্তমান সমাজের চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধানে এক অভাবনীয় সুযোগ প্রদান করতে চলেছে সার্কুলার অর্থনীতি।
বিশ্ব চ্যালেঞ্জ বলতে ক্লাইমেট চ্যালেঞ্জ, র-ম্যাটেরিয়াল চ্যালেঞ্জ, টক্সিসিটি চ্যালেঞ্জ, এনার্জি চ্যালেঞ্জ, পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ, কর্মসংস্থান চ্যালেঞ্জ, সুপেয় পানির চ্যালেঞ্জ, সামাজিক এজেন্ডা এবং ইত্যাদি।
প্রশ্ন জাগে, এই নতুন অর্থনীতির বিজ্ঞানভিত্তিক সংজ্ঞা কী? এই অর্থনীতির পুরোধার কারা বা বাংলাদেশে এ নিয়ে কারা কাজ করেছে বা কীভাবে সার্কুলার অর্থনীতি নিয়ে কাজ শুরু করা যায়? এই প্রশ্নগুলো আজকের নিবন্ধে আলোকপাত করা যেতে পারে।
প্রথমত: বিজ্ঞানভিত্তিক সংজ্ঞা অনুসারে, পুরানো অর্থনীতি-লিনিয়ার মডেলের অলটারনেটিভ হলো সার্কুলার অর্থনীতি। এই অর্থনীতি সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের ভয়েসকে সামনে রেখে, যে কোন পণ্যের ডিজাইন থেকে শুরু করে পণ্য ব্যবহারের পরে তা পুনরায় ম্যাটেরিয়াল হিসাবে ব্যবহার করার পথকে নিশ্চিত করে।
সার্কুলার অর্থনীতি মডেল সুযোগ সৃষ্টি করে নব প্রবর্তিত বস্তুর সঙ্গে মিশ্রণ ঘটায় আমাদের প্রত্যহ জীবন ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক ইকো-সিস্টেমস, ব্যবসা এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। অর্থাৎ সার্কুলার অর্থনীতির পুরোধারগনের মতে, সমাজের সব লোকের জীবিকা অর্জনে গণতান্ত্রিক সার্কুলার অর্থনীতি, বর্তমান পুঁজিবাদী লিনিয়ার অর্থনীতির জগতকে, নিকট ভবিষ্যতে দূরে ঠেলে দিয়ে তৈরি করবে সবার জন্য টেকসই বিশ্ব সবুজ সার্কুলার সমাজ।
আমরা সকলেই অবগত যে, বর্তমান লিনিয়ার পদ্ধতি ন্যাচারাল রিসোর্স (টেক-মেক এবং ডিস্পোজ) নির্ভর অর্থনীতি। অন্যদিকে, সার্কুলার পদ্ধতি ভূ-পৃষ্টের উপরিভাগের রিসোর্স (রিডিউয়জ কঞ্জামসন, রিইউজ এবং রিসাইকেল) নির্ভর অর্থনীতি।
এক কথায়, লিনিয়ার দর্শন পুরনো শিল্প প্রক্রিয়া, অন্যদিকে সার্কুলার অর্থনীতি মডেল অল্টারনেটিভ ট্রান্স ডিসিপ্লিনারি বিজনেস প্রক্রিয়া। এ ছাড়াও পরনির্ভর অর্থনীতির পরিবর্তে স্ব-নির্ভর অর্থনীতির পথকে সুগম করতে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে এই সার্কুলার অর্থনীতি। প্রাসঙ্গিকতায় বলতে হয়, কোভিড-১৯ আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে আমরা কোন ধরনের অর্থনীতি নির্ভর বিশ্বকে রেখে দিতে চাই আগামী প্রজন্মের জন্য।
দ্বিতীয়ত: যারা সার্কুলার অর্থনীতি নিয়ে গবেষণার কাজে নিয়োজিত তারা মনে করেন সার্কুলার অর্থনীতি এক নভোল অর্থনীতি ব্যবসা মডেল, যা নতুন করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ঘটাতে চলেছে।
তাই ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান, চীন, এবং রাশিয়া বিলিয়ন বিলিয়ন ইউরো/ডলার অনুমোদন করেছে এই কম্প্রিহেন্সিভ অর্থনীতির ব্যবসার মডেলকে ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই সমাজ ব্যবস্থার বাধাগুলোকে দূর করার জন্য।
যেমন, জাতিসংঘ ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্স (কোপ-২১), প্যারিস, নভেম্বর ২০১৫, বিশ্বের প্রায় ১৯৫টি দেশ অংশগ্রহণ করার মধ্যদিয়ে একমত হতে চেয়েছে এই বলে যে, টেকসই সমাজ গঠনে বিশ্বে উদ্ভাবিত নতুন কম্প্রিহেন্সিভ অর্থনীতির মডেল কাজে লাগাতে হবে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের সুন্দর জীবনের জন্য।
তৃতীয়ত: ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অন্তর্ভুক্ত ফিনল্যান্ড সার্কুলার অর্থনীতির উন্নয়ন এবং তা ব্যবহারে বিশ্বের একটি পাইওনিয়ার দেশ হিসেবে সর্বপ্রথম সার্কুলার অর্থনীতি ব্যবসা মডেলের রোডম্যাপ ২০১৬-২০২৫ তৈরি করে। কোভিড-১৯কে সামনে রেখে ইউরোপিয়ান কমিশন প্রকাশ করেছে নতুন সার্কুলার ইকোনমিক মডেল।
যাতে প্রাধান্য পেয়েছে ডিজিটালাইজেসনের সঙ্গে পণ্য-অংশীদারমূলক সেবা পদ্ধতি। এখানে উল্লেখ্য যে, সার্কুলার অর্থনীতির নীতিমালাকে সামনে রেখে ইউরোপ খুব কাছাকাছি চলে এসেছে বর্জ্যকে যাদুঘরে পাঠাতে।
চতুর্থত: উপরে আলোচিত বিজ্ঞানভিত্তিক দর্শনের ওপর ভিত্তি করে, বাংলাদেশে সর্বপ্রথম কনসেপচ্যুয়াল ফ্রেমওয়ার্কভিক্তিক একটি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেছে, যার নাম সার্কুলার ফ্যামিলি ইন বাংলাদেশ বা সংক্ষেপে সিএফবি (www.cfb.com.bd)।
বাংলাদেশে সার্কুলার অর্থনীতির ধারনা এবং দক্ষ লোক তৈরির জন্য সিএফবি, সার্কুলার অর্থনীতির সূচনা কোর্স শুরু করেছে নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ এবং আগামীতে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ও সার্কুলার অর্থনীতির সূচনা কোর্স শুরু করবে।
এছাড়াও সিএফবি, সার্কুলার অর্থনীতির বিষয়কে বাংলাদেশের সর্বস্থরে পৌঁছে দেবার জন্য অর্থনীতি বিষয় নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছে বাংলাদেশের নামকরা অর্থনীতিবিদ এবং শিক্ষাবিদদের সঙ্গে।
এই তালিকায় রয়েছেন সাবেক বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান, অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ মোঃ আবদুল্লাহ, অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান চৌধুরী, অধ্যাপক ড. আয়ুউব নবী খান, ড. মাহবুব আলম, বিশ্ব ব্যাংক, সাবেক সিনিয়র সচিব ড. সামসুল আরেফিন, টেক্সটাইল টুডের কর্ণধার এএসএম তারেক আমিন প্রমুখ।
এ ছাড়া বাংলাদেশের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত সার্কুলার অর্থনীতি এবং করোনা পরবর্তী অর্থনীতি নিয়ে আলোচনায় সিএফবি মুখ্য আলোচকের ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সার্কুলার অর্থনীতিকে বেগবান করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
এ ছাড়াও সার্কুলার ফ্যামিলি ইন বাংলাদেশ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সার্কুলার অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা বেশকিছু লিডিং কোম্পানির সঙ্গে কাজ করার সেতু তৈরির দ্বার প্রান্তে। এক কথায়, সিএফবি বাংলাদেশে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। সিএফবি-এর কাজকে ত্বরান্বিত করার জন্য ভবিষ্যতে সরকারের সহযোগিতা অত্যাবশ্যকীয়।
পঞ্চমত: সিএফবি-এর ভাষ্য মতে, বাংলাদেশে সার্কুলার সংস্কৃতি অভ্যাসের মধ্যদিয়ে অর্থনির্ভর ব্যবসা ও ব্যক্তি জীবনে সার্কুলার পরিবর্তন আনার মধ্যদিয়ে সার্কুলার অর্থনীতিকে সহজেই প্রয়োগ করা যেতে পারে।
এছাড়াও সিএফবি মনে করে, সার্কুলার ব্যবসা বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্লাস্টিক রিসোর্স, ওয়াটার রিসোর্স, ফুড রিসোর্স এবং বর্জ্য রিসোর্সকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে আমরা খুব অল্প সময়ে আমাদের অর্থনীতির উন্নতির সুফলকে সমভাবে ভোগ করতে পারি।
সর্বোপরি, উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আশা করি বাংলাদেশের সরকার সার্কুলার অর্থনীতির গুরুত্ব অনুধাবন করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি টেকসই সমাজ গঠনের জন্য বাংলাদেশে সার্কুলার অর্থনীতিকে সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দেবার জন্য প্রণয়ন করবে।
সার্কুলার অর্থনীতি প্রয়োগের নীতিমালা এবং শিক্ষা মাধ্যমে (প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়) চালু করবে সার্কুলার অর্থনীতি বিষয়ক একটি ঐচ্ছিক কোর্স। এভাবেই বাংলাদেশে একটি দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি হতে পারে, যারা আগামীতে সার্কুলার অর্থনীতির মডেলকে ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশকে উপহার দিবে সক্ষম হবে একটি সুখী সন্দর, সবুজ-টেকসই সমাজ।
লেখক: ড. মো. মঞ্জুরে মওলা, ফাউন্ডিং চেয়ারম্যান সার্কুলার ফ্যামিলি ইন বাংলাদেশ, ফিনল্যান্ড থেকে, munjur.sa@gmail.com