
প্রিন্ট: ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ০২:২৫ পিএম
দুদকের তদন্তে কচ্ছপগতি
২৭৫ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি, ১০ কোটিতে রফা
‘নাহিদ এন্টারপ্রাইজ’কে দায়মুক্তি দিতে একের পর এক সাজানো হয় প্লট

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
পুরান ঢাকার ‘নাহিদ এন্টারপ্রাইজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ২৭৫ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করে ২০২১ সালে শোরগোল ফেলে দিয়েছিল ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এর দুই বছর পর সেই ভ্যাট গোয়েন্দাই প্রতিষ্ঠানটিকে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেয়, যা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। এ দায়মুক্তি পেতে ১০ কোটি টাকা ঘুস লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। এ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান করছে। তবে তদন্তে ধীরগতির কারণে প্রকৃত ঘটনা আড়াল হওয়ার পথে।
নাহিদ এন্টারপ্রাইজের ভ্যাট ফাঁকির গোপন সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালে অনুসন্ধান শুরু করে ভ্যাট গোয়েন্দা। অনুসন্ধানের প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানটির কাছে ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ভ্যাটসংক্রান্ত দলিলাদি চেয়ে কয়েকবার চিঠি দেওয়া হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটি কাগজপত্র না পাঠিয়ে চিঠি দিয়ে বারবার সময় চেয়ে কালক্ষেপণ করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তকাজে সহযোগিতা না করায় ভ্যাট গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানটিতে অভিযান চালিয়ে ভ্যাটসংক্রান্ত বাণিজ্যিক দলিলাদি জব্দ করে। জব্দকৃত দলিলাদি যাচাই করে ভ্যাট গোয়েন্দা দেখতে পায়, নাহিদ এন্টারপ্রাইজ প্রকৃত বিক্রয় তথ্য গোপন করে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত প্রায় পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠানটি দাখিলপত্রে বিক্রয়মূল্য দেখিয়েছে ২৯১ কোটি ৮৯ লাখ ৬৬ টাকা। অথচ জব্দ করা নথিপত্র খতিয়ে দেখা যায়, প্রকৃত বিক্রয়মূল্য ছিল ১ হাজার ৫৪০ কোটি ২৬ লাখ ৬৩ হাজার ২২ টাকা।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটিকে দায়মুক্তি দিতে সিনেমার স্ক্রিপ্টের মতো একের পর এক প্লট সাজানো হয়। প্রথমে ভ্যাট গোয়েন্দার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়, পরে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে শুনানিতে ডাকা হয়। এরপর একজন অতিরিক্ত কমিশনারের নেতৃত্বে ভ্যাট গোয়েন্দার প্রতিবেদনের সঠিকতা যাচাই করতে কমিটি করা হয়। ওই কমিটি ভ্যাট গোয়েন্দাকে সম্পূরক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সুপারিশ করে। ইতোমধ্যে ভ্যাট গোয়েন্দার শীর্ষ কর্মকর্তা বদল হন। নতুন কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্বে আসেন ড. আব্দুর রউফ, যিনি এনবিআর-এর ভ্যাট পলিসির সদস্য হিসাবে কর্মরত আছেন। কর্মকর্তাদের মাঝে সততা ও নিষ্ঠা এবং ভ্যাট বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্যের কারণে তিনি ‘ভ্যাট হুজুর’ নামে পরিচিত। তার সততাকে পুঁজি করে প্রকৃত তথ্য গোপন করে তদন্তে নিয়োজিত কর্মকর্তারা সম্পূরক প্রতিবেদন দেন। যাতে বলা হয়, ‘প্রতিষ্ঠানটির বকেয়া ভ্যাট উদ্ঘাটিত হয়নি।’ স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী পুরো নাটক মঞ্চস্থ করতে ঘুস বাবদ ৫ শীর্ষ কর্মকর্তা ১০ কোটি টাকা নেন।
এ ঘটনা নিয়ে কাস্টমসের সাবেক ও বর্তমান একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে যুগান্তর। কর্মকর্তারা বলেন, এনবিআর-এর ইতিহাসে এত বড় চাঞ্চল্যকর ভ্যাট ফাঁকির ঘটনা মাফ করে দেওয়া নজিরবিহীন। কোনো কর্মকর্তাই স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এই ঝুঁকি নিতে চাইবে না। এর পেছনে অন্য কারণ থাকতে পারে। সেটি খুঁজে বের করতে এনবিআর উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারে। যেমনটি করেছিল বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ-ভ্যাট) একটি ভ্যাটের দাবিনামা প্রত্যাহারের ঘটনায়। এলটিইউ-ভ্যাটের দাবিনামা প্রত্যাহার পুনঃপর্যালোচনা করে পরবর্তী সময়ে ওই কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতায় আনা হয়।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার শওকত আলী সাদি ও পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী মেসার্স নাহিদ এন্টারপ্রাইজসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ২৭৫ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। সংস্থার দুই সদস্যের একটি টিম অনুসন্ধানকাজ করছে। গত বছরের ২৮ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত টিম গঠন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত অনুসন্ধান শেষ করে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেননি কর্মকর্তারা। দুই সদস্যের অনুসন্ধান টিমের প্রধান দুদকের সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, অনুসন্ধানকাজ চলছে। তবে কাজ শেষে প্রতিবেদন জমা দিতে আরও সময় লাগবে।
জানা যায়, কাস্টমস কর্মকর্তা শওকত আলী সাদির বিরুদ্ধে অভিযোগ-তিনি ২৫ কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নাহিদ এন্টারপ্রাইজসহ অন্যদের ২৭৫ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির ঘটনা ধামাচাপা দিয়েছেন। এ অভিযোগের অনুসন্ধানে নেমে দুদক কর্মকর্তারা কাস্টমস ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে নানা ধরনের তথ্য-উপাত্ত চেয়ে চিঠি পাঠান। এর মধ্যে নাহিদ এন্টারপ্রাইজের ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে মালামাল বিক্রির প্রকৃত পরিমাণ ও মূল্য গোপনের মাধ্যমে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের দায়ের করা মামলার মূল অভিযোগ, তদন্ত রিপোর্ট, জব্দকৃত আলামত, মামলার সবশেষ অবস্থাসহ যাবতীয় রেকর্ডপত্র চেয়ে পাঠানো হয়। গত বছরের ১৮ জানুয়ারি ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কমিশনারের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠায় দুদক। কিন্তু এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ না করায় পরবর্তী সময়ে ফের চিঠি পাঠানো হয়।
দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, দ্বিতীয় দফার চিঠির জবাবে সাত হাজার এক পৃষ্ঠার নানা ধরনের তথ্য-উপাত্ত দুদকে পাঠায় ভ্যাট কমিশনারেটের কার্যালয়। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করছেন অনুসন্ধান দলের সদস্যরা। একই সঙ্গে তারা নাহিদ এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির মামলা সংক্রান্ত ডকুমেন্টও সংগ্রহ করেছেন। সংগ্রহ করা তথ্যের মধ্যে কাস্টমসের এক পত্রে বলা হয়েছে, ‘নাহিদ এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে মূসক ফাঁকির মামলা পর্যালোচনা কমিটির প্রতিবেদনের ওপর মতামত চাওয়া হয়। ওই বিষয়ে এ দপ্তরের মতামত প্রদানের জন্য একজন উপপরিচালক ও একজন রাজস্ব কর্মকর্তাকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা (দক্ষিণ) কর্তৃক গঠিত কমিটির প্রতিবেদনের সঙ্গে একমত পোষণ করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই প্রতিবেদন মোতাবেক কোনো বকেয়া মূসক উদ্ঘাটন হয়নি।’ কমিটির এই প্রতিবেদন বস্তুনিষ্ঠ কি না, তা যাচাই-বাছাই করতে প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। সাত হাজার এক পৃষ্ঠার যে তথ্য কাস্টমস থেকে দুদককে সরবরাহ করা হয়েছে, তা মিলিয়ে দেখে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করা সময়সাপেক্ষ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।