আইপিডির সংলাপে পরিকল্পনাবিদরা
ব্যবসায়ীদের স্বার্থে ড্যাপ সংশোধনের উদ্যোগ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩৭ পিএম
ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই নতুন করে রাজউকের মাস্টারপ্ল্যান ড্যাপ সংশোধন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনাবিদরা। বুধবার সকালে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) আয়োজিত ভার্চুয়াল সংলাপে বক্তারা এসব কথা জানান।
পরিকল্পনাবিদরা বলেন, সম্প্রতি ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) যেসব সংশোধনীর প্রস্তাব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রকাশ করেছে, সেখানে শহরের বাসযোগ্যতা, ধারণক্ষমতা, নাগরিক সুবিধাদি, পরিবেশ প্রাধান্য পায়নি। গুরুত্ব পেয়েছে আবাসন ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়িক স্বার্থ।
তারা বলেন, ব্যবসায়ী ও স্বার্থান্বেষী মহলের চাপে ড্যাপ (২০২২-৩৫) চূড়ান্ত হওয়ার দুই বছরের মধ্যে দুইবার ড্যাপ সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হলো। ড্যাপ সংশোধন প্রক্রিয়ায় রাজউকের কতিপয় কর্মকর্তা ও পেশাজীবীর এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। বাসযোগ্যতার তলানিতে থাকা ঢাকা শহর থেকে ব্যবসায়িক মুনাফা ও গোষ্ঠীস্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার সংস্কৃতি জুলাই গণঅভ্যুত্থানোত্তর বাংলাদেশে কাম্য ছিল না। এ প্রবণতা চলতে থাকলে যানজট-দূষণে স্থবির ও অবাসযোগ্য হয়ে পড়া ঢাকা আরও নিশ্চল হয়ে পড়বে। এ থেকে উত্তরণের জন্য পরিকল্পনাগত টেকসই কৌশল ও পন্থা কাজে লাগিয়ে জনস্বার্থ, বাসযোগ্যতা, জনস্বার্থ ও পরিবেশকে প্রাধান্য দিয়েই ড্যাপের প্রয়োজনীয় পরিমার্জনা করতে হবে।
সংলাপে পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ড্যাপ সংশোধনে রাজউকের সংশোধনীতে ভবনের আকার-উচ্চতার বাড়ানোর প্রস্তাবনা ছাড়া অন্য কিছু আসেনি। বন্যাপ্রবণ এলাকা, জলাভূমি, কৃষিজমি রক্ষার বিষয়টি উপেক্ষায় থেকেছে। আমরা বলে এসেছিলাম, আবাসন ব্যবসায়ী ও কিছুসংখ্যক পেশাজীবী শুধু ভবন নির্মাণে বেশি এফএআর (ফার) মান বা ভবনের উচ্চতা বাড়ানোর জন্য ড্যাপ বাতিল বা স্থগিতের আবেদন করছে। আমাদের সেই শঙ্কাই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। ড্যাপ সংশোধনে প্রস্তাবিত এরিয়া ফার ও ব্লকভিত্তিক ফার মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাসযোগ্য শহর নির্মাণে পরিকল্পনার ব্যাকরণ অনুসরণ করা হয়নি। ফলে ড্যাপে প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতাকে আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে।
পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, একটি বাসযোগ্য শহরে শুধু আবাসন নয়; পরিবেশ, প্রতিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গণপরিবহণ ইত্যাদি বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়ার কথা। অথচ আমাদের ব্যবসায়ী মহল কেবল ড্যাপ বাতিল এবং ফার বৃদ্ধির কথাই বলছে। এমনকি ফার বৃদ্ধি করা হলে ভবিষ্যতে ওই এলাকা বসবাসযোগ্য থাকবে কি না, তা নিয়ে কোনো গবেষণা করা হয়নি। রাজউকের নীতিনির্ধারক মহলের অনেকেই নগর পরিকল্পনার গুরুত্ব অনুধাবন করতে না পারায় স্বার্থান্বেষী মহলের অন্যায় আবদারের কাছে নতি স্বীকার করছেন। গোষ্ঠীস্বার্থ চিন্তা না করে ঢাকার বাসযোগ্যতা বাড়াতে জনস্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
পরিকল্পনাবিদ রাকিবুল রনি বলেন, আবাসন ব্যবসায়ীদের স্বার্থের সংঘাতের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ড্যাপ পুনর্মূল্যায়ন কমিটিতে রিহ্যাবের সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি বৈষম্যবিরোধী চেতনার প্রতিফলন ঘটায় না। আমাদের স্থপতিদের খেয়াল রাখা দরকার তারা যেন তাদের পেশাগত নৈতিকতা এবং জনস্বার্থের প্রতি দায়বদ্ধতা মাথায় রেখে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট মতামত দেন, ব্যবসায়িক স্বার্থকে যেন অগ্রাধিকার না দেওয়া হয়।
স্থপতি আমিনুল ইসলাম ইমন বলেন, স্থপতিরা কেবল ফার বাড়ানোর কথা বলেননি, সঙ্গে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার অন্যান্য বিষয়েও মতামত দিয়েছেন। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করে বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব নয় বিধায় ঢাকায় আগত মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা করতে হবে। নির্মাণশিল্পের সঙ্গে জড়িত বিশাল জনগোষ্ঠীর কথাও খেয়াল রাখতে হবে।
পরিবেশকর্মী আমিরুল রাজিব বলেন, ড্যাপ নিয়ে বিভিন্ন পেশাজীবীদের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের দায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরেও বর্তায়। দেশের প্রতিটি শহর ঢাকাকে অনুকরণ করার চেষ্টা করে। ফলে ড্যাপ যে কোনো সিদ্ধান্ত সুবিবেচনাপ্রসূত হতে হবে। রিহ্যাবের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। নাগরিক অধিকারের স্থান থেকে শহরের নাগরিক সুবিধাদি বাড়াতে সরকারি সংস্থাগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। কেবল মানুষ নয়, প্রতিটি প্রাণী ও কীটপতঙ্গের কথাও বিবেচনা করে শহরের পরিকল্পনা করতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফরহাদুর রেজা বলেন, একটি শহরের ধারণক্ষমতার ওপর ভিত্তি করেই পরিকল্পনার সব সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের কেবল মুনাফা লাভের চিন্তা শহরের উন্নয়নের অন্তরায়। ফার-এর মান ৩-এর বেশি হলে ওই এলাকায় কী প্রভাব পড়বে বা রাস্তাগুলো কতটুকু কার্যকর থাকবে, তা নিয়ে গবেষণা করা উচিত।
পরিকল্পনাবিদ সাজিদ ইকবাল বিলেন, শুধু ফার-এর মানকে বিবেচনায় নিয়ে ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতির হিসাব করে সম্পূর্ণ ড্যাপ বাতিলের প্রস্তাব দুঃখজনক।
পরিকল্পনাবিদ মনিম আবদুল্লাহ বলেন, কেবল বহুতল ভবন নির্মাণ এবং উন্নয়নের দ্বারা ঢাকার সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব নয়। ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হলে দেশের সব অঞ্চলের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
পরিকল্পনাবিদ রেদওয়ানুর রহমান বলেন, ব্যবসায়িক স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে সব অংশীদারকে যৌক্তিক পরামর্শ বিবেচনায় নিয়ে ড্যাপ পরিবর্তন, পরিমার্জন এবং পরিবর্ধনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।