Logo
Logo
×

ডাক্তার আছেন

পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জারি

আর কত শিশু চিকিৎসার জন্য পথে পথে ঘুরবে?

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. নুরুন্নাহার ফাতেমা

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. নুরুন্নাহার ফাতেমা

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:৩২ পিএম

আর কত শিশু চিকিৎসার জন্য পথে পথে ঘুরবে?

প্রতীকী ছবি

পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জারি নবজাতক থেকে শুরু করে যেকোনো বয়সী শিশুদের করা হয়ে থাকে। আর এই বাচ্চারা বয়সে খুব কম হলেও এই সাবজেক্টের গুরুত্ব অপরিসীম। এই সাবজেক্টের যারা সার্জন রয়েছেন তাদের গুরুত্ব ও অপরিসীম। কারণ তাদের হাতে রয়েছে সেই জাদুকাঠি, যার বলে তারা একটি অত্যন্ত অসুস্থ বাচ্চাকেও সম্পূর্ণভাবে সুস্থ করে দিতে পারেন। আর তাদের এই সুস্থ করার কাজে যারা তাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গে থাকেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন, পারফিউশনিস্ট এনেস্থিসিয়া এবং ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞগণ।

সর্বোপরিভাবে তাদেরকে রোগ নির্ণয় , চিকিৎসা গাইডলাইন এবং পেরি অপারেটিভ পিরিয়ডের অন্যান্য আনুষঙ্গিক চিকিৎসা সহায়তার জন্য রয়েছেন পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্ট গন। এই বাচ্চাদেরকে অপারেশন থিয়েটারে সার্বক্ষণিক সহায়তার জন্য রয়েছেন অপারেশনের অন্যান্য টেকনিশিয়ানবৃন্দ এবং আইসিইউতে তাদেরকে সারিয়ে তোলার জন্য রয়েছেন ইন্টেনসিভিস্ট, সঙ্গে অন্যান্য নার্স এবং টেকনিশিয়ানবৃন্দ।

তাই বোঝা-ই যাচ্ছে একটি শিশুকে ওপেন হার্ট সার্জারি করে সুস্থ করে তুলার ক্ষেত্রে কত বড় একটি টিম একসাথে কাজ করে থাকে, আর এইখানে টিম ওয়ার্কের গুরুত্ব কতটুকু।

কম ওজনের ছোট ছোট বাচ্চাদের সার্জারি আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এবং তাদের পোস্ট অপারেটিভ কেয়ারগুলি খুবই সংবেদনশীল। এসব কারণে শিশুদের সার্জারি করার পরেও মৃত্যু ঝুঁকি অনেক বেশি থেকে যায়।

এসব দিক বিবেচনা করে বিভিন্ন হাসপাতাল তাদের কার্ডিয়াক প্রোগ্রাম এর মধ্যে শিশু কার্ডিয়াক সার্জারি অন্তর্ভুক্ত করতে চায় না। আর তরুণ ডাক্তাররাও শিশু কার্ডিয়াক সার্জারিতে ক্যারিয়ার গড়ার কাজে উৎসাহী হয় না।

বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন হাসপাতালে ১০ থেকে ১২ জন কার্ডিয়াক সার্জন পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জারি  করে থাকেন। এর মধ্যে মাত্র দুই একটি হাসপাতালে জটিল এবং কম ওজনের শিশুদের অপারেশন করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অন্যতম। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি হাজার শিশুর মধ্যে ২০ থেকে ২৫ জন জন্মগত হৃদরোগে আক্রান্ত( রেফারেন্স-CVJ 2008, 1(1): 14-20, NN Fatema, RB Chowdhury, L Chowdhury) তার মধ্যে প্রতি হাজারে ২ থেকে ৩ জন শিশুর জটিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয় যাদের জীবন বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন জটিল ইন্টারভেনশন এবং অপারেশনের দরকার হয়, বাংলাদেশের একটি অন্যতম শিশু হৃদরোগ সেন্টার (বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল) পরিসংখ্যান চালিয়ে দেখা যায় গড়ে একদিনে ৬০ থেকে ৮০ জন শিশু হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বহির্বিভাগে রিপোর্ট করে, যার মধ্যে শতকরা ৩-৪ % রোগী পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জারি তে রেফার করা হয়, দেশের অন্যান্য সেন্টার থেকেও মোটামুটি একে অনুপাতের রোগী পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জারিতে রেফার করা হয়, যার ফলে বিপুল সংখ্যক জটিল হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুরা এই ১০ থেকে ১২ জন পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জন এর কাছে যান, যাদের পক্ষে এত সংখ্যক শিশুদের কার্ডিয়াক সার্জারি করা অসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়,

কিন্তু আমি মনে করি এখন সময় হয়েছে আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন এর। শিশুদের হৃদরোগ এখন মহামারী আকার ধারণ করেছে। আমি নিজে প্রতিদিন অন্তত ৫ থেকে ৬ জন রোগীকে পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়া সার্জন এর কাছে রেফার করে থাকি।

পর্যাপ্ত হাসপাতাল এবং ডাক্তার না থাকলে এই সমস্ত রোগীরা কার কাছে যাবে !!

যে দু একটি জায়গায় এই অপারেশনগুলি হয় সেখানে ওয়েটিং লিস্ট ছয় মাসের উপরে। এই ছয় মাসের মধ্যে বেশিরভাগ রোগী মারা যায়। তাদের ভাগ্যে ছয় মাস পরে সেই ডেটটি দেখার আর সুযোগ হয় না।

আর এই দু একটি হাসপাতালেও অত্যন্ত ক্রিটিকাল যে সমস্ত রোগী রয়েছে বা নবজাতক রয়েছে তাদের চিকিৎসা তেমন একটা পাওয়া যায় না।

পার্শ্ববর্তী দেশ বা অন্যান্য দেশের রেফার করার ক্ষেত্রে ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস এর সম্মুখীন হতে হয়। তার মধ্যে মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়েছে ভিসা না পাওয়া।

আমরা চ্যারিটির মাধ্যমে কিছু রোগীর অপারেশনের চেষ্টা করে থাকি। কিন্তু সেটা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল।

এমতাবস্থায় দেশে পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জারির কোর্স চালু করা এবং অনতিবিলম্বে সেই কোর্সে ছাত্র ভর্তি করে তাদেরকে অভিজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে গড়ে তোলা ছাড়া আর কোন বিকল্প নাই। পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জারি যে কোন সার্জারির তুলনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সার্জারি এবং এর রোগীর সংখ্যা অগণিত। এই সার্জারির প্রচুর ডিমান্ড রয়েছে। আমি আশা করব আমাদের তরুণ ডাক্তাররা এই সাবজেক্টিতে দলে দলে জয়েন করবে এবং আমাদের শিশুদেরকে সার্বিকভাবে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসবে। বাংলাদেশ কলেজ অফ ফিজিশিয়ান এন্ড সার্জনস(BCPS) , বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (BSMMU), ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন (NHF) এবং  ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ (NICVD) এই চারটি প্রতিষ্ঠানকে বিশেষভাবে অনুরোধ করবো অতি দ্রুত এফ সি পি এস(FCPS) ও এম এস(MS) পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জারি কোর্স চালুর উদ্যোগ নিতে,  একটি শিশুকে বাঁচিয়ে তোলা মানে এই পৃথিবীতে শিশুটিকে ৮০-৯০ বছর বেঁচে থাকার সহায়তা করা। পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জন এই শিশুটির মাধ্যমে ৮০-৯০ বছর অন্তত পৃথিবীতে বেঁচে থাকবেন। এটাই বা কম কিসে?

লেখক: শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত চিকিৎসক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম