ধূমপান ডেকে আনে যেসব বিপদ
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ
প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৪, ১১:০৩ এএম
তামাক ব্যবহার বা ধূমপান অত্যন্ত ক্ষতিকারক। বাইরে থেকে দেখলে যদিও বোঝা যায় না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ধূমপানে নিঃশেষ হতে পারে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ। গতকাল বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস উপলক্ষে ধুমপান বা তামাক ব্যবহারের অপকারিতা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ
বিশ্বজুড়ে বহু মৃত্যু ও রোগের কারণ হলো তামাক, যা চাইলেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। এটি মানুষকে বয়সের আগেই মৃত্যুর দিকে টেনে নেয়। দুইভাবে মানুষ তামাক ব্যবহার করে। একটি হচ্ছে ধোঁয়াহীন তামাক যা জর্দা, গুল, সাদাপাতা, নাকে নস্য ইত্যাদি। আরেকটি ধোঁয়াযুক্ত তামাক যা সিগারেট, বিড়ি, চুরোট হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ইদানীং আবার ই-সিগারেট ব্যবহৃত হচ্ছে। সবই শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ধূমপান শুধু ধূমপায়ীকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা নয়, বরং পাশে থাকা অধূমপায়ীকেও সমানভাবে রোগাক্রান্ত ও মৃত্যুর দিকে ধাবিত করছে। ধূমপান বা তামাক ব্যবহারে যে ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা হয় সেগুলো হলো-
▶ ক্যানসার : ধূমপানে হাজার হাজার ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যার মধ্যে ৭০টি রাসায়নিক পদার্থ সরাসরি ক্যানসার সৃষ্টি করে। ধূমপানের কারণে ফুসফুস, মুখ, গলা, খাদ্যনালি, অগ্ন্যাশয়, পাকস্থলী, যকৃত, বৃহদান্ত্র, মলাশয়, স্তন, মূত্রাশয়, কিডনি ও জরায়ুর ক্যানসার হতে পারে।
▶ শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা : ধূমপান সরাসরি ফুসফুসকে প্রভাবিত করে। এটি শ্বাসনালি ও ফুসফুসের অ্যালভিওলিকে ক্ষতি করে। ফুসফুসের বিভিন্ন ব্যাধি যেমন দীর্ঘস্থায়ী ব্রঙ্কাইটিস, এমফাইসিমা এবং সি.ও.পি.ডির মতো শ্বাসযন্ত্রের জটিল সমস্যাগুলোর জন্য ধূমপানকে দায়ী করা হয়। যাদের হাঁপানি আছে তাদের জন্য ধূমপান অত্যধিক ক্ষতিকর। ধূমপায়ীদের যক্ষ্মা এবং ফুসফুসের ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
▶ রক্তনালি ও হৃদরোগ : তামাকের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর পদার্থ নিকোটিন শরীরের রক্তনালি চিকন করে এবং এর কোষ নষ্ট করতে থাকে। রক্তনালির মাঝে প্লাটিলেট জমতে থাকে, ফলে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ধূমপানে হৃদরোগ হওয়ার আশঙ্কা অধূমপায়ীদের চেয়ে দ্বিগুণ এবং উচ্চরক্তচাপের অন্যতম কারণ।
▶ কোলেস্টেরল : ধূমপানে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল বা এল.ডি.এল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেড়ে যায়, কমে যায় ভালো কোলেস্টেরল এইচ.ডি.এলের মাত্রা। এতে রক্তনালিতে চর্বি জমা হয়ে, হতে পারে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, পায়ে পচনশীল রোগ বা বার্জারস ডিজিজ, গ্যাংগ্রিন।
▶ পরিপাকতন্ত্রের ওপর প্রভাব : ধূমপায়ীদের দন্তক্ষয়, ক্ষুধামন্দা, হজমের সমস্যা, গ্যাস্ট্রাইটিস, গ্যাস্ট্রিক, আলসার এবং বদহজমের সমস্যা হয়। সিগারেটের নিকোটিন মানুষের খাদ্যনালির স্ফিংটার বা দরজা অকার্যকর করে দেয়। ফলে অ্যাসিডিটি আরও বাড়ে এবং খাদ্যনালিতে প্রদাহ তৈরি করে।
▶ গর্ভবতীর সমস্যা : ধূমপায়ী নারীদের মা হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। এছাড়া গর্ভবতী মায়েদের জন্যও এটা বেশ ক্ষতিকর। গর্ভের সন্তানের ক্ষতি এবং অকাল গর্ভপাতের আশঙ্কা বেড়ে যায়। ধূমপানের ফলে অকালে শিশুর জন্ম হওয়া (প্রিম্যাচুর বার্থ), শিশুর কম ওজন হওয়া, জন্মের সময় নানাবিধ সমস্যাসহ শিশু মৃত্যুর কারণও হতে পারে।
▶ নিকোটিন আসক্তি বাড়ায় : ধূমপানের দশ সেকেন্ডের মাঝে রক্তের মাধ্যমে নিকোটিন চলে যায় ব্রেইনে, যেটা ব্রেইন থেকে ডোপামিন এবং অন্যান্য নিউরোট্রান্সমিটারকে মুক্ত করতে সাহায্য করে, যেমন এনডরফিন। এগুলো মানুষের শরীরে ভালোলাগার প্রকাশ ঘটায় এবং নিয়মিত ব্যবহারে এক পর্যায়ে আসক্তি বা নেশায় পরিণত হয়।
▶ প্রজনন সমস্যা : ধূমপান নারী ও পুরুষ উভয়ের প্রজননকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করে। নারীদের ক্ষেত্রে প্রজনন সমস্যা, গর্ভাবস্থায় জটিলতা, অকাল জন্মের ঝুঁকি, কম ওজনের সন্তান জন্মদান ইত্যাদি। পুরুষদের যৌন ক্রিয়াকলাপে অক্ষমতা বা ইরেকটাইল ডিসফাংশন এবং শুক্রাণুর গুণগত মান হ্রাস করে।
▶ অন্যান্য জটিলতা : ধুমপানে চোখে কম বয়সেই ছানি পড়তে পারে, হাড় ভঙ্গুর করে তোলে, শ্রবণশক্তি কমায়, ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমায়, যা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপান ত্বকের বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে, ফলে অকালে বলিরেখা দেখা দেয়। ইমিউন সিস্টেম বা দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দূর্বল করে, ব্যক্তির সংক্রমণ এবং অসুস্থতাকে দীর্ঘায়িত করে।
▶ ই-সিগারেট : এটিকে মূলত সিগারেটের বিকল্প। দেশের তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেট গ্রহণের প্রবণতা বেশি। অনেকে সিগারেট ছাড়ার জন্য ই-সিগারেট ব্যবহার করেন। এতে নিকোটিন, প্রপাইলিন গ্লাইকল অথবা ভেজিটেবল গ্লিসারিন এবং সুগন্ধি মিশ্রিত থাকে। এসব রাসায়নিক পদার্থ ফুসফুসের রোগ ও শ্বাসযন্ত্রে ইনফেকশন ঘটাতে পারে। ই-সিগারেটে যেভাবে রাসায়নিক নিকোটিন ব্যবহার করা হয়, এর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে মৃত্যুও হতে পারে। মোট কথা, সিগারেটের মতোই ক্ষতিকর ই-সিগারেট।