Logo
Logo
×

ডাক্তার আছেন

উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে যা করণীয়

Icon

অধ্যাপক ডা. তৌফিকুর রহমান ফারুক

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪, ০৮:৪৯ এএম

উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে যা করণীয়

উচ্চরক্তচাপের কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। সাধারণত বংশগত, লবণ বেশি খাওয়ার অভ্যাস, অতিরিক্ত ওজন, মদ্যপানের কারণে উচ্চরক্তচাপ হতে পারে। কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াও উচ্চরক্তচাপ হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে উচ্চরক্তচাপের সুনির্দিষ্ট কারণ পাওয়া যায় এবং যা চিকিৎসা করলে রোগী পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়, এক্ষেত্রে রোগীর উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন নাও হতে পারে। বিস্তারিত লিখেছেন মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. তৌফিকুর রহমান ফারুক

* কেন হয়

সাধারণত কিডনিতে সমস্যা হলে, হরমোনজনিত সমস্যা হলে, হৃদযন্ত্র থেকে বের হওয়া বড় মহাধমনীতে ব্লক হলে সেকেন্ডারি উচ্চরক্তচাপ হতে পারে। উচ্চরক্তচাপের কিছু পরিবেশগত কারণ, কিছু জেনেটিক বা বংশগত কারণ ও কিছু চাইল্ডহুড বা শৈশবগত কারণ থাকে। পরিবেশগত কারণের মধ্যে রয়েছে অত্যধিক ওজন, শারীরিক পরিশ্রমে অলসতা, খাবারে লবণের আধিক্য ও অত্যধিক মদ্যপান করা। শরীরের ওজনের সঙ্গে উচ্চরক্তচাপের সরাসরি সম্পর্ক আছে। হালকা ধরনের ব্যায়াম করলে উচ্চরক্তচাপের মাত্রা কমে। অতিরিক্ত লবণ খেলে শুধু রক্তচাপই বাড়ে না, ব্রেইন স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকেরও ঝুঁকি বাড়ে। কিছু কিছু ওষুধ বা খাবার আছে যা রক্তচাপ বাড়ায় বা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বাধা দেয় যেমন মদ্যপান, ইয়াবা বা এমফিটামেন জাতীয় ওষুধ। কিছু ওষুধ যেমন যা ডিপ্রেসন কমায়, কফি পান, নাকের সর্দির ওষুধ, কিছু ভেষজ ওষুধ, কিছু শরীর ব্যথার ওষুধ, কিছু জন্ম নিয়ন্ত্রণ ওষুধ, কিছু স্টেরয়েড ওষুধে রক্তচাপ বাড়তে পারে। জন্মের সময় ওজন কম থাকা, অপরিণত অবস্থায় শিশু জন্মগ্রহণ করা, নিম্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থান, অতিরিক্ত মানসিক ও সামাজিক চাপ থাকলেও রক্তচাপ হতে পারে।

* কী কী কারণে রক্তচাপ ওঠানামা করে

দুশ্চিন্তা করলে রক্তচাপ হঠাৎ খুব বেড়ে যেতে পারে আবার দুশ্চিন্তা কমে গেলে বা নিয়ন্ত্রণে এলে রক্তচাপ স্বাভাবিক হতে পারে। যদিও প্রাথমিকভাবে এ বাড়তি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য সাময়িকভাবে কিছু উচ্চরক্তচাপের ওষুধ ও দুশ্চিন্তা নিয়ন্ত্রণের ওষুধ লাগতে পারে, পরবর্তীকালে সাধারণত উচ্চরক্তচাপের ওষুধের প্রয়োজন নাও লাগতে পারে। দুশ্চিন্তা বেশি করলে রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে কমেও যেতে পারে। রোগী যদি দীর্ঘদিন ধরে শরীরের ব্যথা কমানোর ওষুধ বিশেষ করে এনএসএআইডি-জাতীয় ওষুধ সেবন করে তাতে রোগীর রক্তচাপ বাড়তে পারে বা ওঠানামাও করতে পারে। রোগী যদি নিয়মিত ওষুধ না খায় বা মাঝে মাঝে ওষুধ বাদ দেয় তবে রক্তচাপ ওঠানামা করতে পারে। রোগী যদি জন্মনিয়ন্ত্রণের ওষুধ দীর্ঘদিন খান তবে রক্তচাপ বাড়তে পারে বা ওঠানামা করতে পারে। রোগীর যদি কিডনিতে সমস্যা থাকে তাহলেও রক্তচাপ উঠানামা করতে পারে। রোগীর যদি কিছু হরমোনজনিত রোগ যেমন হাইপারথাইরয়েডিজম (থাইরয়েড গ্লান্ড থেকে বেশি বেশি থাইরয়েড হরমোন বের হওয়া রোগ) বা ফিওক্রোমোসাইটোমা (কিডনির ওপর অবস্থিত এড্রেনাল গ্লান্ডের টিউমারের রোগ) জাতীয় রোগ হয় তবে রক্তচাপ ওঠানামা করতে পারে।

* উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার প্রভাব

উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা যেমন ওজন কমিয়ে আদর্শ ওজন বজায় রাখা, স্বাস্থ্যকর খাবার বা ড্যাশ ডায়েট অবলম্বন করা, খাবারে লবণের পরিমাণ কমিয়ে আনা, অধিক পটাশিয়ামযুক্ত খাবার খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা ও মদ্যপান পরিহার করলে ওষুধ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রক্তচাপ কমানো সম্ভব।

* স্বাস্থ্যকর খাবারের ভূমিকা

স্বাভাবিক রক্তচাপ আছে এমন কোনো ব্যক্তি স্বাস্থ্যকর খাবার বা ড্যাশ ডায়েট (শাকসবজি, ফলমূল, আস্ত শস্যদানা ও কম সম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত দুধ ও দুধ থেকে তৈরি খাদ্যসামগ্রী) খান তবে তার সিস্টোলিক রক্তচাপ ৩ মি.মি. পারদ কমানো সম্ভব। আর যদি উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তি স্বাস্থ্যকর খাবার বা ড্যাশ ডায়েট অবলম্বন করে তবে শুধু খাবার নিয়ন্ত্রণ করে সিস্টোলিক রক্তচাপ ১১ মি.মি. পারদ কমানো সম্ভব।

* ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে

রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আদর্শ ওজন বজায় রাখতে হবে। উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তি ওজন কমিয়ে আদর্শ ওজন বজায় রাখে তবে শুধু খাবার নিয়ন্ত্রণ করে সিস্টোলিক রক্তচাপ ৫ মি.মি. পারদ কমানো সম্ভব।

* অতিরিক্ত লবণ খাওয়া বন্ধ করতে হবে

একজন ব্যক্তির প্রতিদিন ১৫ গ্র্রামের বেশি লবণ খাওয়া স্বাস্থ্যকর নয়। অতিরিক্ত লবণ লবণ খাওয়া অবশ্যই কমাতে হবে। যদি উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তি অতিরিক্ত লবণ খাওয়া কমায় তবে শুধু লবণ খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করেই সিস্টোলিক রক্তচাপ ৫-৬ মি.মি. পারদ কমানো সম্ভব।

* খাবারে পটাশিয়াম বাড়াতে হবে

কোনো ব্যক্তির প্রতিদিন ৩৫০-৫০০ গ্রামের বেশি পটাশিয়াম খাওয়া স্বাস্থ্যকর বিশেষ করে যেসব খাবারে পটাশিয়াম বেশি আছে সেসব খাবার বেশি বেশি খেতে হবে।

* নিয়মিত ব্যায়াম করুন

প্রতি সপ্তাহে ১২০-১৫০ মিনিট জোরে হাঁটা ভালো। উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তি নিয়মিত ব্যায়াম করেন তবে শুধু এ কাজ করে সিস্টোলিক রক্তচাপ ৫ মিমি পারদ কমানো সম্ভব।

* রক্তচাপ কীভাবে মাপবেন

একই মানুষের রক্তচাপ বিভিন্ন সময় ও বিভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন হতে পারে, এমনকি দুই হাতে দুই রকমের হতে পারে।

▶ রক্তচাপ মাপতে ভালো ও পরীক্ষিত অটোমেটেড মেশিন ব্যবহার করতে হবে। চিকিৎসকরা সাধারণত যেসব মেশিন রক্তচাপ মাপতে ব্যবহার করেন যেমন পারদযুক্ত বা এনেরয়েড যেখানে রক্তচাপ মাপার জন্য স্টেথোস্কোপ দিয়ে বিশেষ ধরনের শব্দ শোনা হয় তা সাধারণ মানুষের পক্ষে আয়ত্ত করা কঠিন, সময় সাপেক্ষ ও অধিক দক্ষতা প্রয়োজন।

▶ যেসব যন্ত্রে মেমোরি থাকে অর্থাৎ রক্তচাপ মাপার মান সংরক্ষিত থাকে তা ব্যবহার করা ভালো।

▶ রক্তচাপ মাপার মেশিনের সঠিক মাপের কাফ সাইজ ব্যবহার করতে হবে, কাফের ভেতর যে ব্লাডার বা বাতাসপূর্ণ হওয়ার থলি থাকে তা অবশ্যই বাহুর ৮০ ভাগের বেশি প্রস্থের জায়গা পূর্ণ করতে হবে। উপযুক্ত কাফ সাইজের চেয়ে ছোট বা বড় কাফ সাইজ রক্তচাপ মাপার ক্ষেত্রে ব্যবহার করলে তা লিপিবদ্ধ রাখতে হবে।

▶ প্রথমবার রক্তচাপ মাপার সময় অবশ্যই দুই হাতেই রক্তচাপ দেখতে হবে এবং যে হাতে রক্তচাপ বেশি ওই মান লিপিবদ্ধ করতে হবে ও ভবিষ্যতে ওই হাতে রক্তচাপ মাপতে হবে।

▶ রোগীকে পা মাটিতে লাগিয়ে কমপক্ষে ৫ মিনিট আরাম করে চেয়ারে বসতে হবে এক পা আরেক পায়ের ওপর রাখা যাবে না। সোফায় বসে রক্তচাপ মাপা যাবে না।

▶ রক্তচাপ মাপার আগে আধা ঘণ্টার মধ্যে রোগী কোনো রকমের কফি বা চা পান, ধূমপান বা ব্যায়াম বা পরিশ্রমের কাজ করতে পারবে না।

▶ প্রস্রাবের বেগ নিয়ে রক্তচাপ মাপা যাবে না, তাই রক্তচাপ মাপার আগে প্রস্রাবের থলি খালি করতে হবে।

▶ রক্তচাপ মাপার মেশিনের কাফ লাগানোর জায়গায় অর্থাৎ বাহুতে কোনো কাপড় রাখা যাবে না, সব ধরনের কাপড় সরাতে হবে।

▶ বিশ্রাম বা আরাম করার সময় অথবা রক্তচাপ মাপার সময় রোগী বা চিকিৎসক বা যিনি রক্তচাপ মাপবেন কেউই কোনো ধরনের কথা বলতে পারবেন না।

▶ রোগীর যে বাহুতে রক্তচাপ মাপা হবে সে বাহু অবশ্যই টেবিল বা ডেস্কের ওপর রাখতে হবে।

▶ রক্তচাপ মাপার মেশিনের কাফসহ রোগীর বাহু অবশ্যই বুকের মাঝ বরাবর রাখতে হবে।

* প্রতিদিন কয়বার মাপতে হবে

সকালে ওষুধ খাবার আগে ও রাতে খাবার খাওয়ার আগে ১ মিনিট পর পর অন্তত ২ বার করে রক্তচাপ প্রতিদিন মাপতে হবে ও লিপিবদ্ধ করতে হবে। কোনো নতুন ওষুধ যোগ করার বা ওষুধের মাত্রা বা পরিমাণ কমানোর ২ সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতিদিন ও ২ সপ্তাহ পর সপ্তাহে ১ দিন রক্তচাপ মাপার নিয়ম। ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাতের আগে ১ সপ্তাহ প্রতিদিন রক্তচাপ মাপতে হবে ও লিপিবদ্ধ করতে হবে। সাক্ষাতের সময় মেশিনের মেমোরিতে সংরক্ষিত রক্তচাপের মানের ফলাফল বা আলাদা কাগজে লিপিবদ্ধ রক্তচাপ মাপার মান রোগীর সঙ্গে আনতে হবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম