বসন্তে কীভাবে রোগমুক্ত থাকবেন
অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ
প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:১০ পিএম
বসন্তকালে প্রকৃতি অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়। প্রকৃতির এ সজ্জা কিন্তু আমাদের শরীরের রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ সময় গাছে গাছে ফুলের পরাগ রেণু ছাড়ে বলে বসন্তকালে বাতাসে প্রচুর অ্যালার্জেনের আধিক্য পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া বসন্তকালে কিছু ভাইরাস জাতীয় রোগও হতে দেখা যায়।
এখন চলছে বসন্ত। আবহাওয়ায় শুরু হয়েছে তাপমাত্রা পরিবর্তনের খেলা। সকালে ঠান্ডা, দিনের বেলা গরম এবং রাতে শীতল হাওয়া। এ সময় তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, আর ধুলাবালির তারতম্যে দেখা যায় নানা রকম অসুখ-বিসুখ। এ ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের স্বাস্থ্যের নানা পরিবর্তন বা রোগব্যাধি হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই সবাইকে হতে হবে সচেতন, নিতে হবে কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। ঋতুভেদে এসব অসুখের বেশিভাগই ভাইরাসজনিত এবং তা সাময়িক, কিন্তু অস্বস্তিকর। সুবিধা হলো, একটু সতর্ক হলে প্রায় ক্ষেত্রেই ভাইরাসজনিত সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। রোগব্যাধি হয়ে গেলেও তা কিন্তু উদ্বেগের নয়, সহজ চিকিৎসায় নিরাময়যোগ্য।
শ্বাসতন্ত্রের সাধারণ সংক্রমণে করণীয়
সবচেয়ে বেশি রোগব্যাধির প্রকোপ দেখা যায় শ্বাসতন্ত্রের ওপর। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, সবার সর্দি-কাশি বা কমন কোল্ড হতে পারে। প্রায়ই দেখা যায়, দু-তিন দিন নাক বন্ধ থাকে বা নাক দিয়ে পানি ঝরে। গলাব্যথা, শুকনা কাশি এবং জ্বরও থাকতে পারে। এগুলো বেশিভাগই ভাইরাসজনিত। লক্ষণভিত্তিক কিছু চিকিৎসা, কোনো কোনো সময় কোনো চিকিৎসা ছাড়াই ভালো হয়, কোনো অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয় না। তবে শুকনা কাশি কয়েক সপ্তাহ ভোগাতে পারে। ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ, অ্যান্টিহিস্টামিন খেতে হবে। গরম পানিতে গড়গড়া করতে হবে। কুসুম গরম চা বা গরম পানিতে আদা, মধু, লেবুর রস, তুলসী পাতার রস ইত্যাদি পান করলে উপকার পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে ভাইরাসের পরপরই ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করতে পারে। কাশির সঙ্গে হলুদ বা সবুজ রঙের কফ বের হলে সঙ্গে জ্বর থাকলে ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশংকা বেশি। সেক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন। এ সময় আরও ভাইরাস রোগের প্রাদুর্ভাব হতে পারে, যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা, সিজনাল ফ্লু। এ রোগের লক্ষণগুলোও কমন কোল্ডের মতোই। আলাদা কোনো চিকিৎসাও প্রয়োজন হয় না, ওপরের কমন কোল্ডের মতোই উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা দিলেই ঠিক হয়ে যায়।
জলবসন্তের এখনই সময়
জলবসন্ত রোগের প্রকোপও এ সময়ে বেশি হয়। প্রথমে একটু জ্বর-সর্দি, তারপর গায়ে ফোসকার মতো ছোট ছোট দানা। সঙ্গে থাকে অস্বস্তিকর চুলকানি, ঢোক গিলতে অসুবিধা ও গায়ে ব্যথা। এটিও কোনো মারাত্মক অসুখ নয়। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল, শরীর চুলকালে অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ, ক্যালামিন লোশন ইত্যাদি ব্যবহার করলেই রোগের প্রকোপ কমে আসবে। সংক্রমণ বাড়লে অবশ্যই চিকিৎসকের পরমার্শ নেওয়া উচিত।
সাইনাস ও টনসিলের সংক্রমণ
সাইনোসাইটিস এবং টনসিলাইটিস জাতীয় রোগগুলোও এ সময়ে দেখা দিতে পারে। টনসিলের সমস্যা যে কারোই হতে পারে। তবে ছোট বাচ্চারাই বেশি আক্রান্ত হয়। হঠাৎ শীত চলে যাওয়ার প্রাক্কালেও গরমের শুরুতে ঠান্ডা পানীয় বা আইসক্রিম খাওয়ার প্রবণতার কারণে, এমনকি বাচ্চারা স্কুলে বা অন্যান্য জায়গায় ধুলাবালিতে খেলাধুলা করলেও এসব রোগ বাড়ার আশংকা থাকে। যারা হাঁপানি, ব্রংকাইটিস বা শ্বাসজনিত অন্যান্য রোগে ভোগেন, তাদের এ রোগের প্রকোপ এই বসন্তে, এমনকি গরমের শুরুতে বাড়তে পারে। এছাড়া নিউমোনিয়া এবং এর সঙ্গে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট হয়ে থাকে।
ডেঙ্গুজ্বরের কথা ভুলবেন না
এ সময় বৃষ্টির ফলে রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে থাকে। আবহাওয়াও স্যাঁতসেঁতে হয়ে ওঠে। জমে থাকা পানিতে এডিস মশা জন্ম নেয়। এসব মশা ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণু বহন করে। এডিস মশা সাধারণত দিনের কামড়ালেও এখন রাতেও কামড়াতে দেখা যায়। তাই যেসব স্থানে পানি জমে থাকতে পারে যেমন-টব, ডাবের খোসা, প্লাস্টিক কনটেইনার পরিষ্কার ও শুকনো রাখতে হবে। অনেকে ড্রইংরুম গাছ দিয়ে সাজাতে পছন্দ করেন। সে ক্ষেত্রে প্রতিদিন টব রাখার স্থান ভালোভাবে মুছে পরিষ্কার রাখতে হবে। ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ দেখা দিলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
ত্বকের নানা রোগ
বর্ষায় জমে থাকা বৃষ্টির পানি এবং স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার কারণে যে রোগটি বেশি সংক্রমিত হয়, তা হচ্ছে ফাঙ্গাল ইনফেকশন বা চর্মরোগ। দাদ জাতীয় গোল চাকাচাকা ফাঙ্গাস শরীরের নানা জায়গায় হতে পারে। অসহ্য চুলকানি হয়। এগুলো গোলগাল রিং আকারে শরীরে বাড়তে থাকে। তাই অনেক সময় একে রিংওয়ার্মও বলা হয়ে থাকে। আঙুলের ফাঁকে ঘা বর্ষাকালে একটি অতিপরিচিত সমস্যা এবং এতে মিক্স ব্যাকটেরিয়াল ও কেনডিডাল ইনফেকশন হতে পারে। ছুলি রোগ বর্ষার সময় বাড়তে পারে। এক ধরনের ছোপছোপ সাদা অথবা কালচে দাগ মুখে-পিঠে বা বুকে হয়ে থাকে। এসব সমস্যা এড়াতে বর্ষায় ত্বকের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। ত্বক নিয়মিত পরিষ্কার রাখা, সাবান দিয়ে গোসল করা, জামা-কাপড় নিয়মিত পাল্টানো বা পরিষ্কার রাখা এসব সমস্যা থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে।
পেটের ব্যাধি থেকে সাবধান
আরও কিছু কিছু রোগ হওয়ার প্রাদুর্ভাব এ সময় লক্ষ করা যায়। যেমন-প্রচণ্ড গরমে পিপাসার কারণে রাস্তাঘাটে পানি বা শরবত পান করার ফলে পানিবাহিত রোগ হতে দেখা যায়। দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়া খাদ্যদ্রব্য, ফলমূল গ্রহণ করার ফলে প্রায়ই ডায়রিয়াজনিত রোগব্যাধি দেখা দেয়। এমনকি এসব খাবার গ্রহণ করার কারণে টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড, জন্ডিস, সাধারণ আমাশয়, রক্ত আমাশয়ও হতে পারে। তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত তাপমাত্রায় হিট স্ট্রোক বা হিট এক্সহশানের মতো জটিল সমস্যার প্রকোপও দেখা দিতে পারে।
কীভাবে রোগমুক্ত থাকবেন
▶ ধুলাবালি পরিহার করতে হবে।
▶ অতিরিক্ত গরমে যাওয়া এড়িয়ে চলতে হবে এবং ঘাম হলে মুছে ফেলতে হবে।
▶ জ্বর এবং কাশি যদি দুই সপ্তাহের বেশি হয়, সর্দি একেবারে না সারে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অযথা অবহেলা করলে অসুখ জটিল হয়ে যেতে পারে অথবা খারাপ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা থাকে।
▶ ভাইরাসজনিত অসুখে আক্রান্ত রোগীর কাছ থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে হবে।
▶ যারা হাঁপানিসহ শ্বাসযন্ত্রের অন্যান্য রোগে ভোগেন, তারা বাইরে বেরোলে ধুলোবালি পরিহার করুন। প্রয়োজনে মাস্ক ব্যবহার করলে আরও ভালো হয়। বেশিভাগ ক্ষেত্রেই ঠান্ডা পানি বা খাবার খাওয়া, ধুলোবালিতে যাওয়া ইত্যাদি পরিহার করলে এসব রোগ থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব।
▶ সব সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। যেখানে-সেখানে দূষিত পানি বা অন্যান্য পানীয় খাওয়া বর্জন করতে হবে। যারা অতিরিক্ত গরম পরিবেশে কাজ করেন, তারা তরল পানীয়ের সঙ্গে লবণ মিশিয়ে নেবেন। ওরস্যালইনও খেতে পারেন।
▶ পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য গ্রহণ, কাঁচাসবজির সালাদ, ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’যুক্ত ফলমূল গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত পানি পান করা, যা রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
▶ নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করা, নিয়মিত ও পরিমিত কায়িক পরিশ্রম এবং ধূমপান পরিহার করা উচিত।
▶ ঘরবাড়ি তথা ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা। ঘরের দরজা-জানালা খুলে পর্যাপ্ত পরিমাণে আলো-বাতাস প্রবেশের সুযোগ করে দিয়ে নির্মল পরিবেশে বসবাস নিশ্চিত করা।
▶ হাত ধোয়ার অভ্যাস করা, বিশেষ করে নাক মোছার পরপর, বাইরে থেকে আসার পর এবং খাদ্যবস্তুর সংস্পর্শে আসার আগে হাত ধোয়া।
▶ প্রতি বছর ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং পাঁচ বছর পরপর নিউমোনিয়ার টিকা নেওয়া উচিত।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক