যেসব রোগে হঠাৎ মৃত্যু হয়, প্রতিরোধ করবেন যেভাবে
অধ্যাপক ডা. তৌফিকুর রহমান ফারুক
প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:৪৫ পিএম
বাসা, অফিস কিংবা চলতি পথে দেখা যায় হঠাৎই কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। তখন আশপাশের সবার মধ্যে হুলস্থুল শুরু হয়ে যায়। এসময় অনেকে বুঝতে পারেন না আসলে অজ্ঞান হওয়া ব্যক্তির কী হয়েছে বা তাৎক্ষণিক কী করা উচিত। এসময় হয়তো কেউ মাথায় পানি ঢালতে থাকে, কেউ পায়ের তালুতে তেল ঘষে, কেউ মুখের ভেতর কিছু দিয়ে মুখ খোলার চেষ্টা করে। হৃদরোগ, মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ, শরীরে লবণ ও পানির ঘাটতি কিংবা সুগারের মাত্রা অনেক কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে মানুষ জ্ঞান হারাতে পারে। কেউ কেউ মারাও যায়। যদি এভাবে কেউ জ্ঞান হারায় তাহলে তাৎক্ষণিক কী করবেন সেটা নিয়ে পরামর্শ দেওয়া হলো।
কেসস্টাডি-১ : রাসেল, ৩৮ বছর বয়স। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নেই; কিন্তু ধূমপান করেন গত ১২ বছর ধরে। অফিসে হঠাৎ তার বুকে তীব্র ব্যথা, প্রচণ্ড বমি ও অত্যধিক ঘামতে থাকলে সহকর্মীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানান, হাসপাতালে পৌঁছার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। প্রশ্ন হলো, কী কারণে হঠাৎ মৃত্যু হলো? যেহেতু তার বুকে ব্যথা ছিল, সঙ্গে প্রচণ্ড বমি ও অত্যধিক ঘাম ছিল, সুতরাং তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। হার্ট অ্যাটাকে যেহেতু হৃদযন্ত্রের মাংসপেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়; ফলে অনেক সময় হৃদযন্ত্রে উৎপন্ন ও এর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ইলেকট্রিক প্রবাহে গণ্ডগোল হতে পারে; ফলে এক ধরনের ম্যালিগন্যান্ট অ্যারিদমিয়া বা অতি ক্ষতিকর অনিয়মিত হৃদস্পন্দন তৈরি হয়। এর ফলে হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষম বন্ধ থাকে ও হৃদযন্ত্রের পাম্পিং ক্ষমতা শূন্যে নেমে আসে। এ ধারাবাহিকতায় পুরো শরীরে অক্সিজেন ও খাবারের শূন্যতা দেখা দেয়; ফলে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ ও টিস্যুগুলো মারা যায়।
* কী কী রোগের কারণে হঠাৎ মৃত্যু হতে পারে
সাধারণত হৃদযন্ত্রের কোনো রোগ হলে বা আগে থেকে হৃদরোগ থাকলে বা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হলে হৃদযন্ত্রের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ইলেকট্রিক প্রবাহে গণ্ডগোল হলে অতি ক্ষতিকর অনিয়মিত হৃদস্পন্দন তৈরি হয়; ফলে হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় এবং রোগী মারা যায়। তাই হঠাৎ মৃত্যুর জন্য অধিকাংশ সময়ে হৃদযন্ত্রের রোগ দায়ী।
* যেভাবে প্রতিরোধ করা যায়
হৃদযন্ত্রের আগে থেকে সমস্যা থাকলে এবং এ সমস্যার কারণে যদি হঠাৎ মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে, তবে ঝুঁকি কমানোর জন্য বিশেষ ধরনের কিছু ওষুধ আছে, তা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত খেতে হবে। আবার ঝুঁকির মাত্রা যদি খুব বেশি হয়, সে ক্ষেত্রে রোগীর শরীরে এক বিশেষ ধরনের যন্ত্র বা মেশিন যা আকারে খুব ছোট তা চামড়ার নিচে বসিয়ে দেওয়া হয়। এ মেশিনের কাজ হলো যদি রোগীর হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ইলেকট্রিক প্রবাহে গণ্ডগোল হয়ে যা অতি ক্ষতিকর অনিয়মিত হৃদস্পন্দন তৈরি করে, তবে তাৎক্ষণিকভাবে এ মেশিন তা বন্ধ করে স্বাভাবিক হৃদস্পন্দনে ফিরিয়ে আনে।
* করণীয় কী
এক্ষেত্রে রোগীর পাশে যারা থাকবে, তাদের উচিত হবে রোগীকে কোনো শক্ত জায়গায় সোজা করে শুইয়ে দেওয়া, চিৎকার করে আরও লোক জোগাড় করা, দ্রুত হাসপাতালে বা আম্বুলেন্স খবর দেওয়া এবং রোগীকে বেসিক সিপিআর দেওয়া। বেসিক সিপিআরের জ্ঞান না থাকলে অন্ততপক্ষে রোগীর বুকের ওপর জোরে চাপ দেওয়া, এতে অনেক সময় অতি ক্ষতিকর অনিয়মিত হৃদস্পন্দন পরিবর্তিত হয়ে স্বাভাবিক হৃদস্পন্দনে ফিরে আসে এবং রোগী বেঁচে যায়।
* সিপিআর কীভাবে দেওয়া হয়
▶ এক্ষেত্রে প্রথম ধাপেই নিরাপত্তার দিকটা দেখতে বলা হয়। অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যক্তির আশপাশে আগুন বা পানির মতো কোনো বিপদ আছে কি না, তিনি রাস্তার মাঝখানে কি না ইত্যাদি বিষয় লক্ষ্য করতে হবে। প্রয়োজনে পিপিই বা পারসোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট ব্যবহার করা যায়।
▶ দ্বিতীয় ধাপে দেখতে হবে রোগী কোনো সাড়া দেয় কি না। এজন্য রোগীকে ধাক্কা দিয়ে জোরে জোরে ডাকতে হবে। একই সঙ্গে পরীক্ষা করে দেখে নিশ্চিত হতে হবে কোনো রক্তক্ষরণ হচ্ছে কি না।
▶ যদি রোগীর কোনো সাড়া না পাওয়া যায় এবং তিনি যদি নিশ্বাস না নেন, তার পালস না থাকে অথবা যদি বুক ঘড়ঘড় করে, তাহলে এ পর্যায়ে তৃতীয় ধাপে এসে সাহায্যের জন্য ডাকতে হবে ও ৯৯৯ নাম্বারে (অথবা যেটা ইমার্জেন্সি বা জরুরি পরিষেবার নম্বর) কল করতে হবে।
▶ চতুর্থ ধাপে হাঁটু গেড়ে ওই ব্যক্তির পাশে বসতে হবে। এ সময় হাত কাঁধ বরাবর সামনে থাকবে, আর ওই ব্যক্তিকে সমতল জায়গায় চিৎ করে শুইয়ে দিতে হবে।
▶ পঞ্চম ধাপে মূল সিপিআর শুরু। প্রথমে ওই ব্যক্তির বুকের ওপর দুটো হাত প্রতিস্থাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে একহাতের ওপর আরেকহাত রেখে দুইহাতের আঙুলগুলো ধরে তালু দিয়ে চাপ দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন চাপটি অন্তত দুই ইঞ্চি গভীরে যায়। প্রতিবার চাপ দিয়ে ছেড়ে দিতে হবে যাতে বুক আবার আগের অবস্থানে চলে আসে। এর গতি থাকবে মিনিটে ১০০ থেকে ১২০ বার। তবে টানা ৩০ বার এরকম চাপ দেওয়ার পর একটা বিরতি নিতে হবে।
▶ এবার আসবে ষষ্ঠ ধাপ অর্থাৎ মুখ দিয়ে নিশ্বাস দেওয়া। এজন্য মাথা সোজা রেখে থুতনিতে চাপ দিয়ে ওপরে ঠেলে দিতে হবে, এরপর মুখটা হা করতে হবে। তারপর আক্রান্ত ব্যক্তির নাক ধরে একটা স্বাভাবিক দম নিয়ে তার মুখে পুরো মুখ চেপে শ্বাস দিতে হবে। এর স্থায়িত্ব হবে এক সেকেন্ড এবং খেয়াল রাখতে হবে যাতে বুকটা ফুলে ওঠে। এরপর, পরের শ্বাস দেওয়ার আগে মুখ উঠিয়ে সেটি বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে যদি প্রথমবারে বুকের ওঠানামা না হয়, তাহলে মাথাটা আবার নাড়িয়ে নিয়ে মুখটা খুলে দেখে নিতে হবে যে, গলায় বা মুখের ভেতরে কিছু আটকে আছে কি না, যা নিশ্বাসের ক্ষেত্রে বাধা দিচ্ছে।
▶ সপ্তম ধাপে আবারও এরকম ৩০ বার বুকে চাপ দেওয়া চালিয়ে যেতে হবে। এবং আবার মুখে দুবার নিশ্বাস দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে বুকে চাপ দেওয়ার বিরতি যেন ১০ সেকেন্ডের বেশি না হয়।
এভাবে অ্যাম্বুলেন্স বা কোনো সাহায্য না আসা পর্যন্ত সিপিআর চালিয়ে যেতে হবে।
* শিশুদের সিপিআর
অনেক সময় ছোট বাচ্চাদেরও সিপিআর দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। সেটা অবশ্য তাদের হৃদরোগের সমস্যার চেয়ে বেশি দেখা যায় যখন নিশ্বাসে কোনো সমস্যা হয়।
▶ এক্ষেত্রে প্রথমেই একহাত কপালে রেখে মাথাটা পেছনের দিকে নিয়ে থুতনিটা উঁচু করতে হবে। মুখ বা নাকে কোনো কিছু আটকে থাকলে সেটা সরিয়ে দিতে হবে।
▶ এরপর নাক ধরে মুখ থেকে মুখে পাঁচবার নিশ্বাস দিতে হবে একই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে বুকের ওঠানামার দিকে।
▶ এরপর একহাতের তালু শিশুটির বুকের ওপর বসাতে হবে এবং ৫ সেন্টিমিটার (প্রায় দুই ইঞ্চি) পর্যন্ত চাপ দিতে হবে। এ গভীরতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যদি একহাতে সেটা সম্ভব না হয় তাহলে দুহাতের তালু ব্যবহার করা যেতে পারে। এক বছরের নিচের শিশুর ক্ষেত্রে দুই হাতের বদলে দুটি আঙুল ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে চাপের গভীরতা হবে ৪ সেন্টিমিটার বা দেড় ইঞ্চি।
▶ একইভাবে বড়দের মতোই মিনিটে ১০০ থেকে ১২০ বার চাপ দেওয়ার গতিতে, ৩০ বার পরপর দুবার করে মুখ দিয়ে নিশ্বাস দিতে হবে।
শিশুদের ক্ষেত্রেও অ্যাম্বুলেন্স বা কোনো সাহায্য না আসা পর্যন্ত এভাবে সিপিআর চালিয়ে যেতে হবে। হৃদরোগে আক্রান্ত হলে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই অনেক ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যু হয়। সেক্ষেত্রে সিপিআর জানা থাকলে তা জীবন বাঁচাতে, রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
কেসস্টাডি-২ : ৬৭ বছর বয়সি আহমেদ দুই দিন আগে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে জ্ঞান হারালেন। মুহূর্তের মধ্যে জ্ঞান ফিরে পেলেন; কিন্তু হাঁটতে গেলে অনুভব করলেন যে, তার মাথা ঘুরে। তার ডায়াবেটিস নেই, উচ্চ রক্তচাপ নেই, রক্তের চর্বির মাত্রা স্বাভাবিক, কখনো ধূমপান করেননি। রক্ত পরীক্ষা ও অন্যান্য পরীক্ষার পাশাপাশি ইসিজি পরীক্ষায় দেখা গেল হৃদস্পন্দন মিনিটে মাত্র ৩০ বার, যা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম এবং হৃদযন্ত্রের ইলেকট্রিক্যাল লাইনে সম্পূর্ণ ব্লক হয়েছে, যাকে তৃতীয় মাত্রার হার্ট ব্লক বলা হয়। রোগী ও রোগীর অভিভাবক এবং আত্মীয়স্বজনকে বর্তমান রোগ ও রোগের জটিলতা সম্পর্কে কাউন্সেলিং বা পরামর্শ দেওয়ার পর জরুরি ভিত্তিতে অস্থায়ী পেসমেকার লাগানোর অনুমতি চাওয়া হলো। রোগী রাজি হলে একটি অস্থায়ী পেসমেকার লাগানো হয়। বিভিন্ন পরীক্ষার পর যখন নিশ্চিত হওয়া গেল, রোগীর এ শ্লথগতির হৃদস্পন্দন এমনিতে আর স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তখন রোগীকে একটি দুই চেম্বারবিশিষ্ট স্থায়ী পেসমেকার লাগানোর পরামর্শ দেওয়া হলো। স্থায়ী পেসমেকার লাগানোর পর রোগী স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারছে ও মাথা ঘুরা ভাব আর নেই।
* মাথা ঘুরে যাওয়ার কারণ
যদি হৃদযন্ত্রের কোনো রোগের কারণে মস্তিষ্কে হঠাৎ কিছু সময়ের জন্য রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, তবে হঠাৎ করে কেউ মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারে। আবার মস্তিষ্কের কিছু সমস্যার কারণে কেউ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন ভাল্ব যে কোনো কারণে যদি রক্ত বেশি সরু হয়ে যায়, যখন এ সরু ভাল্ব দিয়ে কিছু সময়ের জন্য হৃদযন্ত্র থেকে মস্তিষ্কসহ শরীরের অন্যান্য অঙ্গে রক্ত সরবরাহ বন্ধ থাকে; তখন একজন ব্যক্তি মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারে। হৃদযন্ত্রের ভেতরে বিশেষ করে বাম অলিন্দে কোনো রক্তের চাকা বা টিউমার বড় হলে বা এমন জায়গায় হয়, তা বাম অলিন্দ ও বাম নিলয়ের মাঝখানের মাইট্রাল ভাল্বের মুখ মাঝেমধ্যে বন্ধ করে দেয়, তবে একজন ব্যক্তি মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারে। বাম নিলয় থেকে রক্ত বের হওয়ার রাস্তার দেওয়াল এত বেশি পুরু হলে, রক্ত বের হতে মাঝেমধ্যে সাময়িকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়; তবে কেউ মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারে।
হৃদযন্ত্রের কোনো রোগের কারণে বা অন্য কোনো কারণে যদি অনিয়মিত হৃদস্পন্দন বা খুব খারাপ ধরনের হৃদস্পন্দন যেমন অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন, ভেনট্রিকুলার ট্যাকিকারডিয়া বা ভেনট্রিকুলার ফিব্রিলেশন হয়, ফলে হৃদযন্ত্রের রক্ত পাম্পিং শূন্যে নেমে আসে ও মস্তিষ্কে রক্ত যায় না, তখন মানুষ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। হৃদযন্ত্রের ইলেকট্রিক্যাল লাইনে ব্লক হলেও হৃদযন্ত্রের গতি খুব শ্লথ হলে মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কমে গেলে কেউ মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারে ।
লেখক: হৃদরোগ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসেস, মালিবাগ, ঢাকা।