জিন ও জন্মগত রক্তশূন্যতাজনিত একটি রোগ থ্যালাসেমিয়া। দেশে এ রোগের বাহক প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ মানুষ। এদের বড় অংশই মাতৃগর্ভে থাকতে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। বাবা-মা রোগটির বাহক হওয়ায় তাদের এ পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে না করা এবং বিয়ের আগে কেবল রক্ত পরীক্ষা করলেই ৭৫ শতাংশ রোগী ও বাহক কমিয়ে আনা সম্ভব।
এমন পরিস্থিতিতে রোগটি সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আজ সোমবার পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস-২০২৩’। আন্তর্জাতিক থ্যালাসেমিয়া ফেডারেশন এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে— ‘বি অ্যাওয়ার, শেয়ার কেয়ার থ্যালাসেমিয়া : স্ট্রেনদেনিং এডুকেশন টু ব্রিজ দ্য থ্যালাসেমিয়া কেয়ার গ্যাপ’। অর্থাৎ ‘থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে নিজে জানি, যত্নবান হই, সেবার গ্যাপ পূরণে জ্ঞানার্জন করি।’
চিকিৎসকরা যুগান্তরকে বলেন, থেলাসেমিয়া হলো— রক্তের হিমোগ্লোবিন সম্পর্কিত জিনগত সমস্যা। বাবা-মা উভয়ই ত্রুটিযুক্ত জিন বহন করলে সে ক্ষেত্রে প্রতি গর্ভাবস্থায় সন্তানের ২৫ শতাংশ থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ২৫ শতাংশ সুস্থ এবং ৫০ শতাংশ বাহক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সাধারণ মানুষের চেয়ে এই রোগীদের শরীরে হিমোগ্লোবিন কম উৎপাদন হয়, অথবা ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন তৈরি হয়।
ফলে জন্মের এক বছরের মধ্যেই বাচ্চার রক্তশূন্যতা ও জন্ডিস হতে পারে। সংক্রমণ, হাড় ক্ষয় হতে পারে। নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালনের ফলে রক্তে আয়রনের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে অর্গান টিস্যুর ক্ষতি হয়। অনেকের হার্ট ফেউলিওর ও লিভারে সমস্যা দেখা দেয়। প্লীহা বড় হয়ে যায়। শিশুর আকার ও গড়নে ঘাটতি দেখা দেয়। যথাসময়ে চিকিৎসা না করালে ও সঠিকভাবে রোগটি ধরতে না পারলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
দেশে থ্যালাসেমিয়া রোগীর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সরকারি-বেসরকারিভাবে সেবাদাতাদের অনুমিত হিসাব অনুযায়ী মোট জনগোষ্ঠীর ১০ শতাংশ এর বাহক। অর্থাৎ ১৮ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে এক কোটি ৮০ লাখের থ্যালাসেমিয়া রয়েছে। যাদের অধিকাংশ শনাক্তের বাইরে থাকছে। ফলে রক্তশূন্যতাসহ নানা কারণে অনেক রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।
বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি হাসপাতালের নির্বাহী পরিচালক ডা. এম একরামুল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রটোকল ট্রিটমেন্ট অব থ্যালাসেমিয়া’ নামে আক্রান্তদের এক ধরনের চিকিৎসার মধ্যে থাকতে হয়। এ ক্ষেত্রে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ৯ মিলিমিটারে নেমে এলেই নিয়মিত রক্ত নিতে হয়। আয়রন স্তর এক হাজারের নিচে রাখতে নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। একজন রোগীর বয়স ও ওজন ভেদে প্রতি মাসে ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু সবার পক্ষে খরচ বহন সম্ভব হয় না। সমিতির হাসপাতালে স্বল্প খরচে চিকিৎসা হলেও বেসরকারি মেডিকেলে বেশি লাগে। তা ছাড়া এ রোগের ওষুধগুলো বাইরের দেশের হওয়ায় দামও বেশি। ফলে অনেকে খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
সিলেট এমসি কলেজের শিক্ষার্থী সুমাইয়া দুই বছর বয়স থেকে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত।
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ৪০০ ব্যাগের বেশি রক্ত নিয়েছেন। এজন্য প্রতিবার ঢাকায় আসতে হয়েছে। নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনের আগে সিবিসি, এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি ও সি, সিফিলিস ও ম্যালেরিয়া রোগের পরীক্ষা করাতে হয়। এর পর শুধু রক্তের লাল অংশকে (আরবিসি) আলাদা করে দেহে প্রয়োগ করতে হয়। প্রতি মাসে গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। সম্প্রতি শরীরে আয়রনজনিত কারণে হাড়ের ক্ষয় শুরু হয়েছে। উন্নত চিকিৎসা নিতে বছরে দুইবার করে ভারতে যেতে হচ্ছে। প্রতিবার আড়াই লাখ টাকার বেশি ব্যয় হচ্ছে।
ইডেন কলেজ পড়ুয়া আরেক রোগী নওশিন তাবাসসুম বলেন, থ্যালাসেমিয়া পরিপূর্ণভাবে নিরাময়ের জন্য এখনো কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। তাদের সারাজীবন চিকিৎসার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হচ্ছে। বারবার নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন ও আয়রণজাতীয় ওষুধ সেবন করতে হচ্ছে। কিন্তু বিভাগীয় শহরের বড় মেডিকেল ছাড়া জেলা-উপজেলা পর্যায়ে এই চিকিৎসা নেই। তাই প্রত্যেক জেলা ও উপজেলায় থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক অভিজ্ঞ চিকিৎসক এবং পরীক্ষা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা উচিত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পেডিয়াট্রিক হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এটিএম আতিকুর রহমান বলেন, দেশে মোট জনগোষ্ঠীর ১০ থেকে ১২ শতাংশ থ্যালাসেমিয়ার বাহক ও রোগী। সংখ্যা হিসাবে এক কোটি ৮০ লাখের মতো। এর সঙ্গে প্রতি বছর গড়ে সাত হাজার নতুন রোগী যোগ হচ্ছে। জিনগত রোগটির চিকিৎসা হচ্ছে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট অথবা জিন থেরাপি দেওয়া। যেটি রোগীদের পক্ষে অসম্ভব। তাই সবার আগে রোগ নির্মূলে গুরুত্ব দিতে হবে। বাহক ও রোগী শনাক্ত করতে হবে। রক্তের হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফরেসিস পরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই নির্ণয় করা যায়। বিএসএসএমইউতে থ্যালাসেমিয়া রিসার্চ অ্যান্ড স্কিনিং সেন্টার ও সেন্টারের ওয়েবসাইট করা হয়েছে। বিয়ের আগে তরুণ-তরুণীরা ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও কার্যক্রমের মাধ্যমে রোগটি প্রতিরোধ করতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, দেশে থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসায় মাত্র ৫০ জন শিশু রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। বিভাগীয় শহরে হাতেগোনা কয়েকটি হাসপাতাল ছাড়া এখনো জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সেবা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এতে করে অধিকাংশ বাহকই শনাক্তের বাইরে থেকে যাচ্ছেন। এ জন্য সরকারকে বলা হয়েছে।
এদিকে দিবসটি উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী পৃথক বাণী দিয়েছেন। রোগটির ভয়াবহতা, করণীয় এবং প্রতিরোধে জাতীয় পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হবে। সকাল ৯টায় বিএসএমএমইউতে বৈজ্ঞানিক সেমিনার হবে। ‘রক্তিম সাহারা’ নামে একটি ওয়েবসাইট উদ্বোধন করা হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেলাসেমিয়া ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো থ্যালাসেমিয়া বাহক ও সেবাদাতাদের নিয়ে সচেতনতামূলক শোভাযাত্রা ও লিফলেট বিতরণ করবে। গুলশানে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি পালিত হবে।