মানবদেহের ‘দ্বিতীয় মস্তিষ্ক’ অন্ত্রকে ভালো রাখতে করণীয়
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৩, ১০:৫০ পিএম
ফাইল ছবি
গবেষকরা বলছেন, আমাদের অন্ত্র লাখো নিউরনের সঙ্গে সংযুক্ত, যে কারণে অন্ত্রকে মানবদেহের 'দ্বিতীয় মস্তিষ্ক' হিসেবে ডাকা হয়। পেটের সমস্যায় অনেকেই ভুগে থাকেন। কিন্তু আপনি কি জানেন পেটের সঙ্গে মস্তিষ্কের সম্পর্ক আছে?
আমাদের পরিপাকতন্ত্রের কাজ শুধুমাত্র খাবার দাবার শোষণ করা নয়, বরং এর চাইতেও আরও বেশি কিছু। শরীরে যে পরিমাণ রোগজীবাণু রয়েছে সেগুলো আমাদের শরীরকে অসুস্থ করে ফেলতে পারে। হজমের সমস্যা বা বদহজম, গ্যাস, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি সমস্যা কমবেশি সবাইকে ভোগায়। এজন্য আপনার অন্ত্রের কী প্রয়োজন সেই ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা।
অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম, অন্ত্রের ভেতরে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক এবং অন্যান্য জীবাণুগুলো মানুষের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিয়মিত শরীরচর্চা, মানসিক চাপ কমানো, অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার মাত্রা বাড়িয়ে তোলে এমন খাবার খাওয়াসহ আরও অনেক অভ্যাস অন্ত্রের জন্য উপকারী।
চিকিৎসা বিজ্ঞানী ড. সু্ন্নি প্যাটেল বলছেন, একজন মানুষ তার লাইফ স্টাইলের মাধ্যমে তার মাইক্রোবায়োমের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে। সেটা ভালো হতে পারে আবার খারাপও হতে পারে। তার মতে এটা ‘একটা উপযুক্ত বিনিয়োগ’, যে কাজ করার জন্য ‘আপনি কখনই খুব কম বয়সি বা খুব বেশি বয়সি হতে পারবেন না’৷
অন্ত্রের স্বাস্থ্যের ওপর জিনের তুলনায় বেশি প্রভাব ফেলে খাদ্যের মতো পরিবেশগত কিছু বিষয়। আপনি যা খাচ্ছেন তা শুধু আপনার জন্য পুষ্টি নয়, এটি আপনার অন্ত্রে বসবাসকারী কোটি কোটি জীবাণুকে খাওয়ায় এবং পরিবর্তন করে। আপনার অন্ত্রই আপনার দেহে কোনো ইনফেকশন হলে তার বিরুদ্ধে লড়াই করে। এবং আপনি যে খাবারগুলো খাচ্ছেন তা থেকে পুষ্টি উপাদান শুষে নিয়ে দেহের জন্য সরবরাহ করে।
ড. প্যাটেল বলছেন, আপনি চাইলেই অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়াগুলোকে খুব দ্রুত পরিবর্তন করতে পারেন, এমনকি কয়েক দিনের মধ্যেই এটা করা সম্ভব। তবে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন ও উপকারিতা পেতে কয়েক মাস সময় লেগে যায়।
গাট বা অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে করণীয়:
অন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে প্রথমেই যথাযথ খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। যতটা সম্ভব সবজি খান। বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, ফলমূল, বাদাম, শস্যজাতীয় খাবারে যে ফাইবার থাকে অন্ত্রের জীবাণুগুলো তা ভালোবাসে। অন্ত্রের সুস্থতায় খাদ্য নির্বাচন করা জরুরি।
আমাদের অন্ত্রে রয়েছে কয়েক ট্রিলিয়ন জীবাণুর বসতি। এই জীবাণুগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ কেননা তারা নির্দিষ্ট কিছু পুষ্টিকর উপাদান হজম করতে সাহায্য করে। প্রতিটি মাইক্রোবায়াল গ্রুপ একেক ধরনের খাবারের ওপর কাজ করে। তাই বিভিন্ন বৈচিত্র্যের খাবার অন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নত করে। যা আমাদের আরও সুস্থ হয়ে ওঠার সঙ্গে সম্পর্কিত।
শাক-সবজিতে প্রচুর পরিমাণে ডায়েটারি ফাইবার, ভিটামিন, মিনারেল ও আয়রন থাকে। যেমন- পালং শাক, ব্রকোলি। নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায় এ ধরনের শাক-সবজি থাকলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে। কলায় রয়েছে পর্যাপ্ত ক্যালরি ও ফাইবার। এছাড়া পেঁয়াজ, রসুন, বাঁধাকপিসহ ফাইবারসমৃদ্ধ খাবারও বেশি খাওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রচুর পরিমাণে ফাইবার ও শাকসবজি অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। তবে কারো কারো জন্য ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার সংবেদনশীল হতে পারে। সেজন্য খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনার আগে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে হবে।
শস্যজাতীয় খাবারে থাকে প্রচুর পরিমাণে প্রয়োজনীয় পুষ্টি যেমন ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অন্যান্য মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। শস্যে থাকা ফাইবার আমাদের অন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য প্রিবায়োটিকের কাজ করে। এটা অন্ত্রে থাকা ভালো ব্যাকটেরিয়ার স্বাস্থ্য ভাল রাখে। ব্রাউন রাইস, লাল আটা, ওটস ইত্যাদি খাবারগুলোতে থাকে পর্যাপ্ত ফাইবার।
এগুলো প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখলে পেটের বিভিন্ন সমস্যা এবং কোষ্ঠকাঠিন্যও দূর হতে পারে বলে মত দেন বিশেষজ্ঞরা।
ফার্মেন্টেড ও প্রোবায়োটিক ফুড- এই খাবারগুলোতে ভালো ব্যাকটেরিয়া থাকে। এই ব্যাকটেরিয়া অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। তাই নিয়মিত এ ধরনের খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। যেমন-দই, কম্বুচা, কিমচি, চিজ, ভিনেগার, পাউরুটি, কয়েক ধরনের আচার- এগুলো হলো কয়েক ধরনের ফারমেন্টেড ফুড।
তবে বেশি তেল দেওয়া আচার এবং উচ্চ চর্বিযুক্ত দুধের তৈরি দই পরিহার করতে বলেন বিশেষজ্ঞরা। মূলত টকদই খাওয়ার পরামর্শ দেন তারা। অন্ত্রের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য বিশেষজ্ঞরা অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন।
কিংস কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক টিম স্পেক্টর বলেন, অন্ত্রের মধ্যে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া কমিয়ে দিতে পারে।
এজন্য অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার কম খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি, যার মধ্যে রয়েছে- মিষ্টি বা মসলাযুক্ত স্ন্যাকস, চকলেট বার ও মিষ্টি, সোডা ও কোমল পানীয়, মিটবল, ফিশ নাগেটের মতো ফ্রোজেন খাবার, ইনস্ট্যান্ট নুডলসের মতো প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলো ডায়েটে না রাখার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবারে ‘খারাপ জীবাণু’ থাকে যা অন্ত্রের স্বাস্থ্যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। এমন খাবার গ্রহণের কারণে উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবারগুলোকে কেউ ডায়েট চার্টের বাইরে রেখে দিতে পারেন এমন আশঙ্কাও করেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা আরও বলছেন, অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের গঠন বা খাদ্যের ম্যাট্রিক্স, যান্ত্রিক বা রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যাহত হয় যা খাদ্যকে দ্রুত হজমযোগ্য করে তোলে। ফলে এমন খাবার খেলে তা নিম্ন অন্ত্রে পৌঁছায় না, যা অন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। তবে এক্ষেত্রে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।