শিশুদের শরীরে মেদ জমে কেন, কী চিকিৎসা?
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২২, ১১:৪০ পিএম
সন্তানের সুস্বাস্থ্য কোন বাবা-মা না চান? অনেকে আবার সুস্বাস্থ্য বলতে সন্তানের নাদুস-নুদুস চেহারাকে পছন্দ করেন। সন্তান গোগ্রাসে না খেলে বাবা-মায়ের কপালে ভাজ পড়ে। কিন্তু তারা জানেন না অধিকাংশ সময় অতিরিক্ত ওজন শিশুর শরীরে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
স্থূলতা এমন একটা সমস্যা, যা অনেক সময় নজর এড়িয়ে যায়। শিশুর উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওজন বাড়ে, তবে তা সঠিক অনুপাতে বাড়ছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। না হলে কখন যে আপনার শিশু স্থূলকায় হয়ে যাবে আপনি বুঝতেও পারবেন না।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম।
শিশুর ওজন কেন বাড়ে
দৈহিক ওজন বৃদ্ধির মূল কারণ হলো শক্তি ও তার ব্যবহারের মধ্যে অসঙ্গতি। আমাদের গৃহীত প্রায় প্রতিটি খাবারেই শক্তি ক্যালরি হিসেবে থাকে। আমরা আমাদের পছন্দ, সামর্থ্য ও অভ্যাস অনুযায়ী খাদ্যগ্রহণ করে থাকি। মানুষের বয়স, লিঙ্গ, ওজন আর দৈনন্দিন কাজের ওপর শরীরের ক্যালরির চাহিদা নির্ভর করে।
প্রকৃতপক্ষে কেউ যদি তার প্রাত্যহিক চাহিদার চেয়ে বেশি ক্যালরি প্রতিদিন বা প্রায়ই খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করে, তবে তার বাড়তি অংশ শরীরে মেদ হিসেবে জমতে থাকবে।
প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাবার খেলে শক্তি গ্রহণের তুলনায় যদি ক্যালরি খরচ কম হয় তা হলে দেহের ওজন বাড়তে থাকবে। আমাদের দেহের ভেতরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাজ করার জন্য প্রতি মিনিটে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্যালরি ব্যবহার করে।
আমরা আমাদের গৃহস্থালি কাজকর্ম থেকে শুরু করে রাস্তায় হাঁটাচলা, খেলাধুলা, ছোটাছুটি, কর্মক্ষেত্রের কাজকর্ম এবং কথা বলতেও ক্যালরি ব্যবহার করে থাকি। এ ক্যালরি গ্রহণ ও ক্যালরি ব্যবহারের মধ্যে একটি ভারসাম্য থাকতে হবে।
প্রতিটি মানুষেরই তার সারা দিনের ক্যালরি চাহিদার কাছাকাছি পরিমাণ ক্যালরি খাদ্য ও পানীয়ের মাধ্যমে গ্রহণ করার চেষ্টা করতে হবে। বাড়ন্ত ছেলেমেয়ে ও গর্ভবতী মহিলাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়।
এ ছাড়া সবার জন্য চাহিদা হিসেবে খাদ্যগ্রহণের অভ্যাস করাটা জরুরি। কারও কারও আবার খাদ্য উপাদান পরিবর্তনের বিশেষ দরকার হয়।
কী করে বুঝবেন যে আপনার বাচ্চা স্থূল
নিয়মিত বাচ্চার দৈহিক ওজন মাপুন। প্রত্যেক বয়সের জন্য একটা কাঙ্ক্ষিত দৈহিক ওজন আছে। যদি আপনার বাচ্চার ওজন তার জন্য নির্দিষ্ট মাপের থেকে ২০ শতাংশ বেশি হয়, তা হলে বুঝবেন বাচ্চার ওবেসিটির সমস্যা রয়েছে।
বেসাল মেটাবলিক পার্সেন্টাইল চার্ট (Basal Metabolic Percentile Chart) ব্যবহার করেও ওবেসিটি মাপা যায়। আপনার বাচ্চার মেটাবলিক ইনডেক্স (Metabolic Index) যদি ৯৫ পার্সেন্টাইলের ওপরে হয়, তা হলে জানবেন আপনার বাচ্চা ওবিস গ্রুপে পড়ে।
ওবেসিটির রিস্ক ফ্যাক্টর
বাচ্চারা আজকাল খুব একটা খেলাধুলা ছোটাছুটির সুযোগ পায় না। বাড়িতে বসে ইন্টারনেট সার্ফ বা ভিডিও গেম খেলা বা টেলিভিশন দেখাটাই তাদের কাছে প্রধান আকর্ষণ। এ রকম শারীরিক শ্রমহীন জীবনযাপনের জন্য যথারীতি বাচ্চাদের ওজন বাড়তে থাকে এবং ক্রমশ তারা ওবেসিটির দিকে এগোয়।
টিভি দেখাটা বাচ্চাদের কাছে প্রায় একটা অ্যাডিকশন। খেলাধুলা ছেড়ে বাচ্চারা বাড়িতে বসে টিভি দেখাটা বেশি পছন্দ করে। আর টিভি দেখতে দেখতে চিপস, চকলেট, পপকর্নের মতো মুখরোচক খাবার খাওয়া এখন রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। একদিকে ক্যালরি গ্রহণ বৃদ্ধি, অন্যদিকে খেলাধুলার প্রতি অনীহা— সব মিলিয়ে ওজন দ্রুত হারে বাড়তে থাকে।
বাচ্চাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তারা কী খেতে ভালোবাসে, বেশিরভাগ বাচ্চাই উত্তর দেবে— চকলেট, কোল্ড ড্রিংকস, আইসক্রিম, রোল। আর কেক পেস্ট্রি তো আছেই। এক কথায় জাঙ্ক ফুড। এসব খাবারের মধ্যে ক্যালরির পরিমাণ খুব বেশি থাকে যা স্বাভাবিকভাবেই ওজন বাড়িয়ে দেয়।
বাচ্চারা সাধারণত বাবা-মাকে দেখে অনেক কিছু শেখে। আর আজকের দিনে বাবা-মায়েরাই যেহেতু শারীরিক শ্রম/ব্যায়াম/এক্সারসাইজের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়ে। ফলে দৈহিক স্থূলতা অর্জন ও শারীরিক স্থূলতা হয়ে পড়ে এবং রেজাল্ট ইজ ওবেসিটি।
বেশিরভাগ পরিবারেই আজকাল বাচ্চার সংখ্যা ১ বা ২ থাকে। ফলে বাবা-মায়েরা একটু বেশি তাদের প্যাম্পার করে থাকেন। বাচ্চার স্বাস্থ্য ভালো হবে এ ভেবে অনেক সময় তারা বেশি করে বাচ্চাকে খাওয়াতে থাকেন।
শুধু বাচ্চাকে খুশি করতে তার যা খেতে ইচ্ছা করে সেই খাবার নিমিষে হাজির হয়ে যায়, তা সে যতই হাই ক্যালরিযুক্ত খাবার হোক না কেন।
চাইল্ডহুড ওবেসিটির নেগেটিভ ইফেক্টস
ছোটবেলায় যদি আপনার বাচ্চা অতিরিক্ত মোটা হয়, বড় হয়ে ওজন আরও বাড়তে পারে, ফলে নানারকম অসুখ যেমন করোনারি হার্ট ডিজিস, ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন ইত্যাদি হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। অতিরিক্ত ওজনের ফলে বাচ্চা সহজেই ক্লান্ত এবং কর্ম উদ্যমহীন হয়ে পড়ে।
অনেক সময় মোটাসোটা বাচ্চারা স্কুলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে পুরোপুরি অংশগ্রহণ করতে পারে না। কখনো কখনো অন্য বাচ্চারাও নানারকমভাবে স্থূলকায় বাচ্চাদের টিজ করে। ফলো ওদের মধ্যে হীনমন্যতাবোধ বা মানসিক চাপ দেখা যায়।
প্রতিকার
ছয় মাস বয়স পর্যন্ত বাচ্চাকে শুধু মায়ের বুকের দুধ খাওয়ান, এতে ওবেস হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।
বাচ্চাকে স্বাস্থ্যকর খাবার অভ্যাস গড়ে তুলতে উৎসাহিত করুন। সুষম খাদ্যের ওপর নজর দিন। খেয়াল রাখবেন যেন খাদ্যে প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল পরিমাণমতো থাকে। কোনো কিছুরই আধিক্য যেন না থাকে, তা হলেই বাচ্চা ভালোভাবে বেড়ে উঠবে। টিভি দেখতে দেখতে বাচ্চার চিপ্স, সফট ড্রিংকস খাওয়ার অভ্যাসকে প্রশ্রয় দেবেন না। আউটডোর গেমস খেলতে বাচ্চাকে উৎসাহ দিন।
বাড়িতে জাঙ্কফুড খাওয়ার অভ্যাস কমান। বাচ্চাকে বাড়ির খাবার সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে খেতে দিন, যাতে বাইরের খাবারের প্রতি আকর্ষণ কমে যায়।