
প্রিন্ট: ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১১:১৭ পিএম
সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের ২৫ ভাগের বেলায় এমন হয়

ডা. সাঈদ এনাম
প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০১৯, ১০:৪৫ এএম

ছবিটি প্রতীকী
আরও পড়ুন
লাল মিয়াকে যখন নিয়ে আসেন, তখন তার হাত-পা শিকল দিয়ে বাঁধা, বড় বড় দুটো তালা। এত বড় তালা খুব কম যায়। ঘোরতর মানসিক রোগী; যাদের আমরা সাধারণত লে-ম্যানদের ভাষায়- 'পাগল' বলি। যে শিকল দিয়ে বাঁধা হয়, সেটি থাকে খুব শক্ত কিন্তু তালাগুলো থাকে ছোট। লাল মিয়ার ঘাড় মুড়িয়ে হাত ও পায়ে বাঁধা শিকল ও তালা দুটোই যথেষ্ট বড়।
আত্মীয়স্বজন চারপাশ ঘিরে আছেন তার, পাছে ভায়োলেন্ট হয়ে কাউকে আঘাত করে বসে। একবার পালাতে চেয়েছিল, বহু পথ পাকড়ে ধরেছেন এনেছেন। বললাম- এত শিকল কেন?
স্যার বলবেন না আর, হাত ফসকালে 'ফের ১৭ বছর'।
'ফের ১৭ বছর, বুঝলাম না তো'
মা বললেন, 'বাবা, এ আমার কলিজার টুকরা। আজ থেকে বছর ১৭ আগে একদিন হঠাৎ তার মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখলাম। কিছু বোঝার আগেই নিরুদ্দেশ হয়। নাই নাই নাই। কোথাও নাই।
হাসপাতাল, মর্গ, পুলিশ, সাংবাদিক কিছুই বাকি রাখিনি তখন। কিন্তু পাইনি। এতটা বছর সে নিরুদ্দেশ। কাঁদতে কাঁদতে চোখ অন্ধ। প্রতিবার নামাজ পড়ে আল্লাহকে বলতাম- হে রাব্বুল আলামীন, আমার কলিজার টুকরাকে বাঁচিয়ে রাখো, যত কষ্ট দেয়ার সব আমাকেই দাও...'
গত পরশু বাড়ির পাশে এক অপরিচিতকে ঘোরাঘুরি করতে দেখেন বাড়ির লোক। ময়লা কাপড়, উশকোখুশকো চুল, আর অগোছালো দাড়ি-গোঁফ। বয়স আনুমানিক ৪০-৪৫ এর কোঠায়। ছোট ছোট বাচ্চারা তাকে নিয়ে শুরু করেছে রঙতামাশা। এটা সেটা ছুড়ছিল তার ওপর। কিন্তু লোকটা বাড়ির আশপাশ ছাড় ছিল না। বাড়ির দিকে বারবার উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। সম্ভবত কাউকে খুঁজছে।
কিছু যুবকের সন্দেহ হলে তারা তাকে আটক করেন। জিজ্ঞাসাবাদে আবোলতাবোল বললে সন্দেহ হয় তাদের, এ কি 'ছেলেধরা' নাকি?
'হাউকাউ' শুনে বাড়ির অন্দরমহলের সবাই এলেন ছেলেধরা দেখতে। অপরিচিত আগন্তুক শুনে লাঠি ভর দিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসেন বাড়ির মুরব্বি বৃদ্ধা। তিনি প্রায়ই অপরিচিত কেউ আসছে শুনলে তাকে দেখতে যান।
তাকে দেখে কথিত 'ছেলেধরা'খ্যাত 'মানসিক বিকার'গ্রস্ত লোকটি স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে বৃদ্ধার দিকে। চোখাচোখি হয় দুজনে।
বৃদ্ধা কাছে এসে কাঁপা কাঁপা হাতে লোকটির মুখ, ঠোঁট, কপাল, দুই হাত দিয়ে স্পর্শ করে ক্রমশ হাতড়াতে থাকেন। ক্ষনিকবাদেই 'আমার লালাইরে...' বলে চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান। 'পাগলটি' তখন দে দৌড়। কিন্তু পারে না, সবাই ধরে বেঁধে ফেলে। এ যেন বাংলা ছবির শেষ দৃশ্যের মিলনের মতো পলকেই সবকিছু ঘটে গেল।
দীর্ঘ ১৭ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া তাদের কলিজার ধন 'লাল মিয়াকে' উদ্ধারের কাহিনী এভাবে বলে যাচ্ছিলেন তার আপন ছোট ভাই ধলাই মিয়া। অথচ সেই তাকে চোর বলে মারতে ঔদ্ধত্য হয়েছিলেন।
দুই.
সেলুনে নিয়ে লাল মিয়ার চুল-দাড়ি-গোঁফ সুন্দর করে সেভ করানো হয়। গোসল দিয়ে জামাকাপড় পরানো হয়। সাদা ধবধবে পোশাক পরানো হয়। এবার একে একে চাচা-ফুফু সবাই চিনলেন। চিনলেন সেই সতেরো বছর আগে কোনো এক শীতের সকালে বাড়ি থেকে হারিয়ে যাওয়া তাদের আদরের লাল মিয়াকে। তার পর গলা ধরে হাউমাউ করে কান্না। কিন্তু লাল মিয়া নির্বিকার। সে কিছুই বোঝে না এসব। কেবল কাইকুই করছে সুযোগে শিকল ভেঙে পালানোর।
লাল মিয়ার যে মানসিক অবস্থা, এখন সে মোটেই ওষুধ খাবে না। তাই তাকে ক্লিনিকে ভর্তি করে শর্ট কোর্স ইঞ্জেকিটেবল অ্যান্টিসাইকোটিক আর সেডেটিভের ওপর তিন দিন রেখে অবজারভেশনে রাখলাম। সপ্তাহ পর থেকে লাল মিয়া একটু একটু করে ওষুধ খেলো। তবে সে কেবল মায়ের হাতেই ওষুধগুলো খায়। আর কেউ না।
ধীরে ধীরে তার ব্রেইন কাজ করা শুরু করল। তার ইনসাইট আসতে থাকে। ব্রেইনের ডোপামিন ব্যালেন্স হয়। একসময় সে জিজ্ঞেস করল, 'মা বাজান কই?'।
মা তাকে কেঁদে কেঁদে জবাব দেন, 'বাজান রে তোর চিন্তায় চিন্তায় তোর বাবা আমাদের চেড়ে চলে গেছে...।' লালুর চোখের কোনে অশ্রু জমে।
বিগত ১৭ বছর লাল মিয়া কোথায় ছিল, কার সঙ্গে ছিল, কী করত, এসব ধীরে ধীরে বলতে পারল। সে নাকি প্রায় সময় রাস্তাঘাট, কবরে, মাজারে, শ্মশানে স্টেশনে বা বিভিন্ন গাঁজা সেবনের আড্ডায় পড়ে থাকত। পাগল বলে মাঝেমধ্যে কেউ কেউ খাবার দিত, টাকা দিত। আবার কেউ কেউ কখনও তাড়াতো।
সে বলল, মায়ের কথা মনে হলে সে নাকি মাঝেমধ্যে গ্রামে আসত মাকে দেখতে। এক পলক দেখে আবার চলে যেত। তাকে কেউই চিনত না। ছন্নছাড়া পাগল ভাবত।
তার কথার সত্যতা মিলল তাদের গ্রামের এক চা দোকানির কথায়। সে বলল, একে আমি কালেভদ্রে ঘুরঘুর করতে দেখতাম, আবার কোথায় হারিয়ে যেত। চুল-দাড়ি-গোঁফে ঢেকে থাকত। চেনা দায়।
তিন.
প্রায় মাস তিনেকের চিকিৎসায় লাল মিয়া পুরো সুস্থ হয়ে গেল। সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত রোগী শতকরা ২৫ ভাগের বেলায় এমন হয়। ঠিকমতো ওষুধ আর আদর-যত্নে পুরো ভালো হয়ে যায় রোগী। তবে সিগারেট-গাজা-মাদক থেকে আলাদা রাখতে হয়। কারণ সিজোফ্রেনিয়া রোগীরা সহজেই এসবে জড়িয়ে যায়।
একদিন ফলোআপে লাল মিয়ার মা এসে বললেন, 'বাবা রোজ নামাজ পড়ে আপনার জন্য দোয়া করি। আপনার জন্য আমার কলিজার টুকরা লালু আমারে চিৎকার কইরা 'মা' কইয়া ডাকে। আমার প্রাণ জুড়ায় যায় সেই ডাক শুনে। বাজান এই ডাক শোনার জন্য ১৭ বছর থাইকা আমার কইলজা আকুপাকু করছিল, আল্লায় আপনার ভালো করুক বাজান।'
আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম- 'আচ্ছা ছেলেকে চিনলেন কীভাবে এত বছর পর, লম্বা চুল, দাড়ি, গোঁফে নাকি তাকে কেউ চিনত না?'
তিনি বললেন, 'বাজান, এরে আমি পেটে ধরছি...? আমার আদরের বড় পোলা। বড় আদরের। রক্ত রক্তরে চিনতে ভুল করে না। রক্ত তার রক্তের ঘ্রাণ পায়...। আমার ক্যান জানি মনে হইতো, আমার লালু মরে নাই। তাই আল্লাহর কাছে কানতাম, প্রতিদিন কানতাম। ওরে যেদিন চোর বলে ধরে সবাই মারতে যায়, আমার কইলজা তখন কেমন জানি হঠাৎ মোচড় দিয়া ওঠে..."
চার.
সিজোফ্রেনিয়া রোগীকে ভালো রাখতে হলে তাদের ধীরে ধীরে ছোটখাটো কাজ দিতে হয়। তাতে রিলাপ্স রেইট কম থাকে। তাই বলেছিলাম- লাল মিয়াকে ওষুধের পাশাপাশি বাড়ির সামনে একটি টি স্টল বা পাঁচ মিশালী সদাই পাতির টং ঘর করে দিতে। চা-বিস্কুট, পান-সুপারি এসবের দোকান।
লাল মিয়া এখন সুস্থ, পুরোটাই সুস্থ। তার দোকান খুব ভালো চলছে- 'লাল মিয়া টি স্টল'।
লাল মিয়ার জন্য এখন পাত্রীও খোঁজা হচ্ছে।
ভাবছি একদিন চা খেতে যাব লাল মিয়ার টি স্টলে।
লেখক : ডা. সাঈদ এনাম
সাইকিয়াট্রিস্ট