নবজাতকের শরীরেও এন্টিবায়োটিক অকার্যকর, এর জন্য দায়ী কে?
ডা. জোবায়ের আহমেদ
প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০১৯, ০৯:৫৬ এএম
এন্টিবায়োটিকের মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি ঔষধের যথেচ্ছ ব্যবহার চলছে এই দেশের আনাচে কানাচে, যা আমার কাছে এক ধরনের অনাচার মনে হচ্ছে।
একটা বিভীষিকাময় সময় আমাদের খুব সন্নিকটে যখন সব এন্টিবায়োটিক তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলবে।লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে, চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না।
এখনই চারদিনের নবজাতকের শরীরে প্রায় জীবনরক্ষাকারী সব এন্টিবায়োটিক অকার্যকর এমন কেইস পাওয়া গেছে।
এর জন্য দায়ী কে?
প্রথমেই আমি দায়ী করবো আপনাকেই। আপনার অসচেতনতাই আপনাকে সেই বিপর্যয়ের মুখোমুখি করে দিচ্ছে বা দেবে নিকট ভবিষ্যতে। দেশে প্রচুর এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স পাওয়া যাচ্ছে।
হাইকোর্টের নির্দেশনা আছে, রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ব্যতীত এন্টিবায়োটিক বিক্রি নিষিদ্ধ। কিন্তু এন্টিবায়োটিকের এই অযাচিত ব্যবহার ও বিক্রি প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না।
আমাদের মত রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের কাছে আসার আগেই এক দুই দিনের জ্বরে আপনি যখন একজন ঔষধ বিক্রেতাকে ডাক্তার মেনে ফার্মেসি থেকে এন্টিবায়োটিক খেয়ে আসেন,তখন অসহায় এর মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমাদের।
ইদানিং ঔষধ কোম্পানি নেমেছে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায়। তারা বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে পল্লী চিকিৎসকদের পিসি কনফারেন্স করে মক্সিফক্লাসিন,সেফটিবিউটেনের মতো পাওয়ারফুল এন্টিবায়োটিক বিক্রিতে উৎসাহ দিচ্ছেন যা ইতিমধ্যেই মারাত্মক আকার ধারণ করছে।
যত বেশি এন্টিবায়োটিক চালাতে পারবে অনেক কোম্পানি তার জন্য বিভিন্ন মাসোহারা ও উপহার পাঠাচ্ছে। এসব কারণে ফার্মেসির মেডিসিন বিক্রেতাদের লোভী হয়ে পড়েছেন।
সরকারি হসপিটাল, ইউনিয়ন সাব সেন্টার, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে ফ্রি ঔষধের জন্য মানুষ ভিড় করে,সেখান থেকে পূর্ণ কোর্স এন্টিবায়োটিক না দিয়ে দুই বা তিন দিনের এন্টিবায়োটিক সরবরাহ করা হয় যা এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্সের অন্যতম আরেকটা কারণ। রোগী কিন্তু নিজের টাকায় সেই এন্টিবায়োটিকের কোর্সের বাকি মেডিসিনগুলো কিনে খায় না।
অনেক রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ও অনেক অপ্রয়োজনীয় এন্টিবায়োটিক লিখে থাকেন যা চূড়ান্ত হতাশাজনক।।
অনেক রোগী আছেন এমন ভাবেন,আরে এত সামান্য জ্বর সর্দি, এর জন্য ডাক্তার দেখিয়ে ভিজিট দিবো কেন?
ফার্মেসী থেকে বলে মেডিসিন খেলেই ত হয়।
আপনি যখন ফার্মেসী তে যাচ্ছেন, উনি আপনাকে ম্যাজিক দেখানোর জন্য এজিথ্রোমাইসিন,মক্সিফক্লাসিন,সেফটিবিউটেন,
সেফিক্সিম দেওয়া ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারেন না। অথচ একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ভাইরাল ফিভারে আপনাকে কখনোই এন্টিবায়োটিক দেবেন না।
বাচ্চাদের জ্বর হলেই মা বাবা অস্থির হয়ে যান। একবেলা মেডিসিন খাওয়াতেই জ্বর ভালো হয়ে যেতে হবে।ধৈর্য বলে কিছুই নেই উনাদের। আমি একবার এক বাচ্চা রোগী পেলাম যার মা সেই বাচ্চাকে এক দিনে তিনজন ডাক্তার দেখিয়েছেন। আমি হা হয়ে তাকিয়ে ছিলাম সেই মায়ের দিকে। আমি ছিলাম চতুর্থ ডাক্তার। আমার কাছে আসার আগেই এজিথ্রোমাইসিন সকালে,বিকালে সেফিক্সিম ও রাতে সেফট্রিয়াক্সন ইঞ্জেকশান মেরে আসছে।
একদিনের জ্বরে তিনটা এন্টিবায়োটিক! অথচ এটা ছিল ভাইরাল ফিভার। মায়ের অশান্তিতে কিছু কিছু রেজিস্টার্ড চিকিৎসকও রোগী হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে অপ্রয়োজনীয় এন্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন।
আপনার তিনবার পাতলা পায়খানা হলেই আপনি একটা ফিলমেট,একটা সিপ্রোসিন, দুইটা এজিথ্রোমাইসিন খেয়ে ফেলছেন নিজে নিজেই বা ফার্মেসির বিক্রেতার পরামর্শে।
ডায়ারিয়াতে মূল চিকিৎসা খাবারের স্যালাইন। কিন্তু অনেক মা তাদের বাচ্চাদের নিয়ে আমাদের কাছে আসেন যেখানে সেই দরকারি স্যালাইন না দিয়ে একগাদা এন্টিবায়োটিক খাওয়ানোর পর আমাদের কাছে আসেন। যদি জিজ্ঞেস করি,স্যালাইন খাওয়াইছেন,তখন বিরস মুখে উত্তর দেন,বাচ্চা স্যালাইন খায় না।
মুখে না খেলে শিরায় স্যালাইন দিতে হবে যখন বলি, তখন মামাবাড়ির আবদার করে বসেন,আপনি এন্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন দিয়ে দেন।।
দুই দিন আগে স্থানীয় একজন ভদ্রলোক উনার নয় মাসের বাচ্চাকে নিয়ে রাত ১২টায় আমার চেম্বারে আসলেন।জ্বর কাশি,ব্রিদিং ডিফিকাল্টি নিয়ে। Acute bronchiolitis এর রোগী।
আমি যখন জানতে চাইলাম কী মেডিসিন খাওয়াচ্ছেন?
উত্তর এলো- সেফিক্সিম চলছে স্যার কিন্ত জ্বর কমছে না। ৭ দিন আগে আবার সেফট্রিয়াক্সন দিছি। এখন আপনার কাছে আসছি। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম!
কিছুদিন আগে আরেকটা অদ্ভুত প্রেসক্রিপশান ফেলাম।
রোগীর একদিনের জ্বর।
এক ডোজ সেফট্রিয়াক্সন ২ গ্রাম ইঞ্জেকশন দিয়ে পরে
তিন দিনের এজিথ্রোমাইসিন দেওয়া। কিছু কোম্পানি এন্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশনে বিশেষ ছাড় দেয়,লোভনীয় অফার দেয়,এক শ্রেণির ফার্মেসির বিক্রেতারা যাদের আপনি ডাক্তার বানিয়েছেন, সেই সুযোগের উত্তম ব্যবহার করছেন।
প্রেসক্রিপশন ছাড়া এন্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধে মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ এসেছে। কিন্তু আপনি যদি নিজে সচেতন না হউন,আপনি যদি নিজেকে না ভালোবাসেন, তাহলে আইন করে কি এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার রোধ করা সম্ভব কিনা তা নিয়ে আমি সন্ধিহান।
একমাত্র জনসচেতনতাই পারে এই এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ও এন্টিবায়োটিক নিয়ে অনাচার রোধ করতে।
আসুন নিজে সচেতন হই।
আগামী প্রজন্মকে এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্সের ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা করতে আজই নেমে পড়ি।
রেজিস্টার্ড চিকিৎসক এর পরামর্শ ছাড়া ফার্মেসি থেকে এন্টিবায়োটিক খাওয়ার ভয়ংকর বদ অভ্যাস পরিত্যাগ করুন।।পূর্ণ মেয়াদে এন্টিবায়োটিক খাবেন।
তবে সবার আগে কে ডাক্তার সেটা জেনে নেবেন।
আপনার সচেতনতাই আপনাকে ও আপনার প্রিয়জনকে নিরাপদ রাখতে পারে।
লেখক: ডা. জোবায়ের আহমেদ
নির্বাহী পরিচালক, ডা. জোবায়ের মেডিকেয়ার অ্যান্ড প্যাথলজি সেন্টার, বিয়ানীবাজার, সিলেট।