Logo
Logo
×

সুস্থ থাকুন

মানবকল্যাণ ও সুস্বাস্থ্যের বছর

Icon

ডা. শাহাদাত হোসাইন শিশির

প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মানবকল্যাণ ও সুস্বাস্থ্যের বছর

নতুন আবিষ্কারের জন্য চলতি বছর ছিল সফল। বিজ্ঞানীরা শিখেছেন কী উপায়ে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কীভাবে কৃত্রিমভাবে হার্ট প্রতিস্থাপন করা যায়। একইসঙ্গে তারা একটি রক্তপরীক্ষা আবিষ্কার করেছে, যা সহজেই ৬৫ বছরের বেশি বয়সের ব্যক্তিদের অটোইমিউন রোগ শনাক্ত করে এবং বুঝতে পেরেছেন কেন নারীরা এ রোগের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। লিখেছেন ডা. শাহাদাত হোসাইন শিশির

* টিরজাপাটাইড : ওজন কমানোর এক নতুন বিপ্লব

বিশ্বব্যাপী ওজন বৃদ্ধি এবং স্থূলতা একটি বড় সমস্যা। টিরজাপাটাইড নামক একটি নতুন ওষুধ ওজন কমানোর ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

▶ টিরজাপাটাইড কী : এটি একটি ইনজেকশন, যা মূলত টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি ওজন কমাতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। ওষুধটি GLP-1 (Glucagon-like peptide-1) এবং GIP (Glucose-dependent insulinotropic polypeptide) নামক দুটি হরমোনকে সক্রিয় করে, যা ক্ষুধা কমায় এবং খাদ্যের হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে।

▶ কীভাবে কাজ করে : টিরজাপাটাইড পেটে খাবারের প্রবাহ ধীর করে, ফলে দীর্ঘসময় পেট ভরা থাকে। এটি মস্তিষ্কে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণকারী হরমোনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে, ফলে ক্ষুধার অনুভূতি কমে যায়। পাশাপাশি, শরীরের ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে ফ্যাটের জমাট বাঁধার হার কমায়।

▶ গবেষণার ফল: টিরজাপাটাইড ব্যবহারকারী রোগীরা ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে তাদের শরীরের ওজনের ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে সক্ষম হন। এটি স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের মতো রোগের ঝুঁকি কমাতেও সহায়ক।

▶ সতর্কতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া : যদিও টিরজাপাটাইড অত্যন্ত কার্যকর, তবে এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, যেমন- বমি বা বমিভাব, ডায়রিয়া, পেটে অস্বস্তি ও ইনজেকশনের স্থানে জ্বালাপোড়া। তাই এ ওষুধটি ব্যবহারের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।

* হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট

হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা প্রতিস্থাপন করা হয় তখন, যখন হার্টের সমস্যার জন্য অন্যান্য চিকিৎসা কাজ করে না, ফলে হার্ট ফেইলিউর হয়। চলতি বছর এ চিকিৎসায় ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট হলো একজন ব্যক্তির থেকে অসুস্থ হৃৎপিণ্ডকে অপসারণ করা এবং একটি দাতার কাছ থেকে একটি সুস্থ হার্ট সেখানে প্রতিস্থাপন করা। টোটাল আর্টিফিশিয়াল হার্ট (TAH) ইমপ্লান্টেশন হলো হার্ট ফেইলিউর রোগীদের জন্য একটি বিকল্প চিকিৎসা যাদের হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের জন্য অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকতে হয়।

* BiVACOR বা টোটাল আর্টিফিশিয়াল হার্ট

চলতি বছর টোটাল আর্টিফিশিয়াল হার্ট নামে একটি চিকিৎসা পদ্ধতি প্রথম মানুষের মধ্যে ইমপ্লান্টেশন করা হয়। আমেরিকার টেক্সাসে বেলর সেন্ট লুকস মেডিকেল সেন্টারে এ পদ্ধতিতে একাধিক রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

* আলঝেইমার

এটি একটি মস্তিষ্কের অবস্থা যা স্মৃতিশক্তি, চিন্তাভাবনা, শেখার এবং সংগঠিত করার দক্ষতার ক্রমবর্ধমান পতন ঘটায়। সাধারণত ৫৫ বছরের বেশি বয়সি ব্যক্তিদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়। এ রোগের কোনো স্থায়ী নিরাময় নেই, তবে কিছু ওষুধ অস্থায়ীভাবে লক্ষণগুলোর অবনতিকে ধীর করে দিতে পারে। চলতি বছর এ রোগের ওষুধ আবিষ্কার হয়েছে। পাশাপাশি রোগটি প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করার জন্য Phosphorylated tau 217 (pTau217) নামে একটি রক্তপরীক্ষা আবিষ্কৃত হয়েছে।

* অটোইমিউন রোগ

সিস্টেমিক লুপাস ইরাইথোমেটোসাস এবং রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস নামক অটোইমিউন রোগ নারীদের বেশি আক্রান্ত করে। বিজ্ঞানীরা এ বছর আবিষ্কার করেছেন, একটি ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়া রয়েছে যা একজন নারীর দুটি এক্স ক্রোমোজোমের মধ্যে একটি বন্ধ হওয়ার জন্য দায়ী। যার কারণে এ রোগটি হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি প্রোটিন যা এক্স ক্রোমোজোমকে নীরব করে তা শরীরে অটোইমিউন রোগের অনুঘটক হিসাবে কাজ করে। বিশেষজ্ঞরা এ বছরের শুরুর দিকে বলেছিলেন, এক্স ক্রোমোজোম নিষ্ক্রিয়তার সঙ্গে যুক্ত প্রক্রিয়াগুলো নারীদের মধ্যে কিছু অটোইমিউন রোগের অন্যতম কারণ বলে মনে হচ্ছে, তবে এর প্রভাব বোঝার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।

* সিজোফ্রেনিয়া

এটি একটি মানসিক ব্যাধি। এ রোগের পূর্ববর্তী যত ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে তা সাধারণত ডোপামিন নামক রিসেপ্টরের ওপর কাজ করে। এ রোগীদের একটি দীর্ঘ সময়ের জন্য ওষুধ সেবন করতে হয়। কিন্তু রোগীরা প্রায়শই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য ওষুধ সেবন বন্ধ করে দেয়, ফলে পূর্বের উপসর্গ আবার দেখা দেয়। চলতি বছর কবনেফি (Cobenfy) নামে একটি ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে যেটি সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসার জন্য একটি ভিন্ন পদ্ধতিতে কাজ করে এবং যার ফলস্বরূপ, কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম হওয়ার কারণে রোগীরা ওষুধটি একটি দীর্ঘ সময়ের জন্য সেবন করতে সক্ষম।

* এইচআইভি

এইডস ভাইরাসজনিত রোগ। এ রোগ রক্ত বা যৌন মিলনের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে। এইডস রোগের কোনো প্রতিষেধক নেই, তবে এর চিকিৎসার বিভিন্ন ওষুধ আছে। চলতি বছর এ রোগের চিকিৎসায় লেনাকাপাভি নামে একটি ওষুধ আবিষ্কার হয়েছে, যা চিকিৎসা ও প্রতিষেধক দুভাবেই সফল হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। এ ওষুধ ছয় মাসে ১ বার ইনজেকশন হিসাবে নিতে হয়। লেনাকাপাভির এইচআইভি ভাইরাসের ভেতরে ক্যাপ্সিড প্রোটিনের বিরুদ্ধে কাজ করে। ওষুধটি আমাদের শরীরের চর্বি কোষে জমে থাকে, ধীরে ধীরে নিঃসরণ হয়, তাই অনেকদিন ধরে কাজ করে। অন্যান্য ওষুধের মতো এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। বিভিন্ন রেসিস্টেন্ট কেস অর্থাৎ যার প্রচলিত ওষুধে কাজ করে না, তাদের জন্যও এই ওষুধ ৯৬ শতাংশ কার্যকর। গবেষণায় দেখা গেছে, এটি এইচআইভি সংক্রমণের হারও উল্লেখযোগ্য হারে কমায়।

* শীতকালীন রোগের টিকা আবিষ্কার

শীতের মৌসুমে মানুষের মধ্যে বিশেষ করে বৃদ্ধ ও বাচ্চারা বিভিন্ন রকম রেসপিরেটরি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হন। চলতি বছর ফ্লু এবং কোভিড-১৯ শনাক্তকরণে একটি পরীক্ষা আবিষ্কৃত হয়েছে। বাড়িতে বসেই সহজেই এ পরীক্ষা করা যায, যা ইনফ্লুয়েঞ্জা-এ, ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি এবং কোভিড ১৯ শনাক্ত করতে পারে। অন্যদিকে, ফ্লু এবং কোভিড ১৯-এর জন্য মানুষকে একাধিকবার টিকা প্রদান করা খুব কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিজ্ঞানীরা একটি সংমিশ্রণ টিকা আবিষ্কার করেছেন যা একই সঙ্গে ফ্লু এবং কোভিড ১৯ রোগের বিরুদ্ধে কাজ করবে। এটি একটি RNA ভ্যাকসিন যা মর্ডানা কোম্পানি আবিষ্কার করেছে এবং বিজ্ঞানীরা এর বিভিন্ন কার্যকরী দিক পর্যালোচনা করছেন। আশা করা যায় ২০২৫ সালে এ টিকা সবার জন্য সহজলভ্য করা হবে।

লেখক : সহকারী রেজিস্ট্রার (নিউরোলজি), ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হসপিটাল, ঢাকা।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম