হৃৎস্পন্দন : জীবনের শুরু ও শেষ যেখানে
অধ্যাপক ডা. তৌফিকুর রহমান ফারুক
প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
হৃৎস্পন্দন : জীবনের শুরু ও শেষ যেখানে
আগামীকাল বিশ্ব হার্ট দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য yes, use heart for actions-অর্থাৎ হৃদয় দিয়ে হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে। শুধু সচেতনতা বাড়ানোর জন্য কাজ করলেই চলবে না। সবাইকে হৃদযন্ত্রের যত্ন নিতে সাহায্য করার পাশাপাশি তাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। যাতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দ হৃদরোগকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয় এবং একটি কমন বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম বা মঞ্চে কাজ করে। Actions বলতে সজ্ঞানে, প্রবল ইচ্ছা সহকারে চেষ্টা করা বোঝায়। এ অ্যাকশনটা শুধু সচেতনতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকবে। তাই এ কাজের actions-এর ধরন হবে দুই ধরনের-একটি হলো পলিসি বা নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলতে চেষ্টা করা ও দ্বিতীয়টি স্বাস্থ্যকর জীবনব্যবস্থা অর্জনে আচরণগত পরিবর্তন এবং নিয়মিত শরীরচর্চা করার জন্য সচেতনতা তৈরি করা। বিস্তারিত লিখেছেন রাজধানীর মালিবাগের মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসেস’র মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. তৌফিকুর রহমান ফারুক।
বিশ্ব হার্ট দিবসের থিম বাস্তবায়নের জন্য প্রধানত তিনটি গ্রুপের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে ও তাদের লাভবান হওয়ার জন্য বা লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনটা পিলার বা স্তম্ভের রূপরেখা প্রদান করা হয়েছে।
▶ শতকরা ৭৫ ভাগেরও বেশি হৃদরোগে আক্রান্ত মানুষ মারা যায় কম ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। মানবজাতি যাতে হৃদরোগ প্রতিরোধ ও সময়মতো প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পায় সে ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।
▶ আমাদের নিজেদের ও পৃথিবী নামক গ্রহের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখার জন্য প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে। হৃদরোগে আক্রান্ত শতকরা ২৫ ভাগ রোগী বায়ুদূষণে মারা যায়। তাই বায়ুদূষণ কমাতে জীবাশ্ম জ্বালানি ও তেলের ব্যবহার কমাতে হবে। এজন্য আমাদের যাতায়াতে মোটরযানের ব্যবহার কমিয়ে বেশি হাঁটতে হবে বা সাইকেল ব্যবহার করতে হবে। বায়ুদূষণ সংক্রান্ত আইন যাতে যথাযথ প্রয়োগ হয় সে ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকতে হবে।
▶ মানসিক চাপ হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি দ্বিগুণ করে। নিয়মিত ব্যায়াম, মেডিটেশন, পর্যাপ্ত পরিমাণে ভালো ঘুম, আমাদের মানসিক চাপ অনেকটা কমায়।
* হৃদযন্ত্র কীভাবে সুস্থ রাখবেন
▶ স্বাস্থ্যকর রান্না করা ও খাওয়া, বেশি বেশি শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম করা এবং শিশুদের খেলাধুলায় উৎসাহিত করতে হবে।
▶ অধিক ক্যালরিযুক্ত বা শর্করা জাতীয় খাবার শরীরের ওজন বাড়ায় ও ডায়াবেটিস রোগের প্রধান কারণ। স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করতে হবে। স্বাস্থ্যকর খাবারে শাকসবজি, ফলমূল, বিভিন্ন ধরনের শস্যদানা, শিম ও বিচি জাতীয় খাবার থাকবে, যেখানে প্রচুর প্রোটিন বা আমিষ থাকে।
▶ বাদাম, মাছ বিশেষত সামুদ্রিক তেলওয়ালা মাছ যাতে প্রচুর অসম্পৃক্ত চর্বি বা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে যা রক্তে ভালো কোলেস্টেরল বা এইচডিএলয়ের মাত্রা বাড়ায়। এটি হৃদযন্ত্রের করোনারি রক্তনালিতে ও অন্যান্য রক্তনালিতে ব্লক হওয়ার আশঙ্কা কমায়, ফলে হার্ট অ্যাটাক, মস্তিষ্কে স্ট্রোক ও হাত-পায়ের পচন বা গ্যাংগ্রিন হওয়ার ঝুঁকি কমায়। রান্নার তেল যেমন-সানফ্লাওয়ার ওয়েল, সয়াবিন তেল, ক্যানোলা ওয়েল, কর্ণ তেল, ওলিভ ওয়েল, বাদামের তেল, স্যাফ্লাওয়ার তেল।
▶ কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার যেমন-ভাত, রুটি, আলু, চিনি, মিষ্টি, কোমল পানীয়, চিনি বা গুড়ের শরবত, মিশ্রি, মধু, কেক, রসালো ও বেশি মিষ্টি ফল কম খেতে হবে, কারণ কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবারে প্রচুর ক্যালরি থাকে। অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার কম খেতে হবে।
▶ চর্বি জাতীয় খাবার কম খেতে হবে। পশুর মাংসের যে অংশে চর্বি বেশি থাকে তা বর্জন করতে হবে। লিন কাট মিট খাওয়া যাবে, যেখানে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি থাকে এবং এ প্রোটিন অতি উচ্চমাত্রার ও অতি উচ্চগুণ সম্পন্ন।
▶ ট্রপিক্যাল উদ্ভিজ্জাত তেল যেমন-পাম ওয়েল, নারিকেল তেল খাওয়া স্বাস্থ্যকর নয়। কারণ তেলে প্রচুর সম্পৃক্ত চর্বি বা ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে যা রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল বা এলডিএলের মাত্রা বাড়ায়। লার্ড এবং মার্জারিন স্বাস্থ্যকর নয় কারণ এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে সম্পৃক্ত চর্বি বা ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে যা রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল বা এলডিএলের মাত্রা বাড়ায়।
▶ অতিরিক্ত ওজন হৃদরোগ ও মস্তিষ্কে স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে এবং নিয়মিত খেলাধুলা ও ব্যায়াম করতে হবে। ওজন কমানোর জন্য প্রতিদিন যে পরিমাণ ক্যালরি গ্রহণ করবেন তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ক্যালরি খরচ করতে হবে। ক্যালরি খরচ করার উত্তম পন্থা হলো নিয়মিত জোরে হাঁটা বা জগিং করা।
* কীভাবে হাঁটবেন বা ব্যায়াম করবেন
সপ্তাহে কমপক্ষে ৫ দিন ও প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০-৪৫ মিনিট হাঁটা হৃদরোগ ও ওজন কমাতে সহায়ক। যদি নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস না থাকে সেক্ষেত্রে অতি উৎসাহী হয়ে টানা ৪৫ মিনিট হাঁটলে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হতে পারে ও তারপর হাঁটার উৎসাহ কমে যায়। শরীরে ব্যথা হলে প্যারাসিটামল ওষুধ খেয়ে ব্যথা কমিয়ে হাঁটা অব্যাহত রাখা অথবা হাঁটার কোনো একটি প্রোটোকল মেনে চলা। সহজ ও সর্বজনপ্রিয় প্রটোকল হলো প্রতি সপ্তাহে আস্তে আস্তে হাঁটার পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া, যেমন-প্রথম সপ্তাহে প্রতিদিন ৫ মিনিট টানা, পরের সপ্তাহে প্রতিদিন ৭ মিনিট, তার পরের সপ্তাহে প্রতিদিন টানা ১০ মিনিট হাঁটা। এভাবে প্রতি সপ্তাহে হাঁটার পরিমাণ ২-৩ মিনিট বাড়াতে হবে এবং অবশেষে হাঁটার পরিমাণ বাড়িয়ে প্রতিদিন ৪৫ মিনিট জোরে হাঁটা যা হৃদরোগ প্রতিরোধ ও ওজন কমাতে সহায়ক। বাসার আশপাশে পর্যাপ্ত হাঁটার জায়গা না থাকলে ইলেকট্রিকচালিত ট্রেডমিল মেশিনে হাঁটতে পারবেন। এতে প্রতিদিন কত কিলোমিটার হাঁটা হলো ও কত ক্যালরি খরচ হলো তার হিসাব রাখা যায়। বৃষ্টি-বাদলের দিন অথবা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় যখন বাইরে যাওয়া সম্ভব না বা ঝুঁকিপূর্ণ তখনো বাসায় ট্রেডমিলে হাঁটা যায় এবং প্রতিদিনের হাঁটার রুটিনের ব্যত্যয় হয় না। প্রচুর গরমের সময় যখন বাইরে বেশিক্ষণ হাঁটলে অতিরিক্ত ঘামে পানিশূন্যতা ও লবণশূন্যতার আশঙ্কা থাকে এমন বাসায় ট্রেডমিলে হাঁটলে সে আশঙ্কা থাকে না।
* ধূমপান ত্যাগ করতে হবে
ধূমপান ত্যাগ করার দুবছরের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। পরোক্ষ ধূমপানও ক্ষতিকর, তাই নিজে ধূমপান না করলেও বা ধূমপান ছেড়ে দিলেও ধূমপায়ীর কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। ধূমপান ছাড়ার ১৫ বছরের মধ্যে একজন সাবেক ধূমপায়ীর হৃদরোগের ঝুঁকি একজন অধূমপায়ীর মতো ঝুঁকিমুক্ত হয়ে যায়।
* উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে
রক্তচাপের মান জানতে হবে ও উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন করতে হবে, রক্তের চর্বির মাত্রা জানতে হবে ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।