
প্রিন্ট: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৩৬ এএম
আশুলিয়ায় ৬ লাশ পোড়ানোর তদন্ত প্রতিবেদন
জীবিত একজনকে পুড়িয়ে হত্যা করে পুলিশ
ছাত্র-জনতার আন্দোলন: ‘শিগ্গিরই আনুষ্ঠানিক চার্জ দাখিলের মধ্য দিয়ে বিচারের কাজ শুরু হবে’ * তিন থেকে চারটা মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে * ঈদের পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলার প্রতিবেদন

আলমগীর মিয়া
প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
গণ-অভ্যুত্থানের বিজয়ের দিন ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় আন্দোলনকারীদের গুলি করে হত্যার পর লাশ পোড়ানোর দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠেছিল গোটা দেশ। এ মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা জানতে পারে, ৬ জনের মরদেহ যখন পোড়ানো হচ্ছিল, তখনো একজন আন্দোলনকারী জীবিত ছিলেন। জ্যান্ত দেখেও তার চিকিৎসা না করে জ্বলন্ত আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে পুলিশ। এরকম লোমহর্ষক তথ্য উঠে এসেছে গণহত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে। এরই মধ্যে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আশুলিয়ায় হত্যার পর ৬ লাশ পোড়ানোর মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে। রোববার দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টের গণহত্যা মামলায় আশুলিয়ায় হত্যার পর ৬ লাশ পোড়ানোর ঘটনার মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে। এটিই প্রথম কোনো মামলা, যার তদন্ত সম্পন্ন হলো।
মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘একটি রিপোর্ট আমাদের হাতে চলে এসেছে। বাকি তিন থেকে চারটি মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে আছে। আমরা আশা করছি, ঈদের পরপরই এ রিপোর্টগুলো হাতে আসবে। রিপোর্টগুলো আসার সঙ্গে সঙ্গেই পর্যালোচনা করে আনুষ্ঠানিক যে অভিযোগ (ফরমাল চার্জ), আমরা তা দাখিল করব। আর ফরমাল (আনুষ্ঠানিক) চার্জ দাখিলের মধ্য দিয়েই আনুষ্ঠানিক বিচারের যাত্রা শুরু হবে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বিচার করতে গেলে যৌক্তিক সময় লাগবেই, হতাশ হলে চলবে না। আমরা আমাদের দায়িত্বের প্রতি সচেতন। জাতীয় প্রত্যাশার জায়গা থেকে এ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য যা কাজ আছে, আমরা তা করব। অবশ্যই খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে তা দেখতে পাবেন।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এ মামলায় তদন্ত করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা জানতে পারে, ৬ জনের মরদেহ যখন পোড়ানো হচ্ছিল, তখনো একজন আন্দোলনকারী জীবিত ছিলেন। তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, তারা তদন্তে পেয়েছেন, ছয়জনকে পোড়ানোর সময় একজন নড়াচড়া করছিলেন। সেই জীবিত যুবককে চাইলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারতেন। কিন্তু কতটা নিষ্ঠুর হলে তারা জীবন্ত একজনকে পুড়িয়ে হত্যা করে। আশুলিয়ায় গণহত্যার মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়, যা ইতোমধ্যে চলে এসেছে প্রসিকিউশনের কাছে। আশুলিয়ার মামলায় আসামি করা হয়েছে ১০ জনকে। ঈদের পর শেখ হাসিনার মামলাসহ আরও কয়েকটি প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার কথা। এছাড়া ঢাকার উত্তরা, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, চানখাঁরপুলে হত্যাযজ্ঞের মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, ৫ আগস্ট সকাল ৯টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত পুলিশ, স্থানীয় এমপি সাইফুল ইসলাম ও তার ক্যাডার বাহিনী ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুলিতে আশুলিয়ায় নিহত হন অন্তত ৩১ জন। পরদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও ১৫ জন মারা যান। এছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল দেড় হাজারের বেশি মানুষ। যাদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে গেছেন। সাভার ও আশুলিয়ায় ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মারা যান অন্তত ৭৫ জন। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে লাশ পোড়ানোর একটি ভিডিও। মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক ও লোমহর্ষক ওই ঘটনায় ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি ছিল ১ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের।
ভিডিতে দেখা যায়, গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকাদের দুজন পুলিশ সদস্যের একজন হাত এবং একজন পা ধরে ভ্যানে একটি লাশ নিক্ষেপ করছেন। সর্বশেষ লাশটি তুলে একটি ব্যানার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। শেষে পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি দেখা মেলে। ভিডিওর ১ মিনিট ৬ সেকেন্ডে একটি পোস্টার দেখা যায়, যা স্থানীয় ধামসোনা ইউনিয়ন সভাপতি প্রার্থী ও ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী আবুল হোসেনের। সেই পোস্টারটি দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় যে ভিডিওটির ঘটনাস্থল আশুলিয়া থানার আশপাশে। পুলিশ লাশগুলো তাদের থানার সামনে নিয়ে যায়। সেখানে একটি পুলিশভ্যানে লাশগুলো রেখে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
লাশ পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় ১১ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দুটি অভিযোগ করা হয়। দুটি অভিযোগই অভিন্ন হওয়ায় একটি মামলা হয়। এ মামলায় ২৪ ডিসেম্বর স্থানীয় সাবেক এমপি সাইফুল ইসলামসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এ মামলায় সাইফুল ইসলাম পলাতক থাকলেও ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. আব্দুল্লাহিল কাফী, ঢাকা জেলা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহিদুল ইসলাম, তৎকালীন ওসি এএফএম সায়েদ, ডিবি পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন, এসআই মালেক এবং কনস্টেবল মুকুলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘দল হিসাবে আওয়ামী লীগের বিচারের সুযোগ আছে। তবে সিদ্ধান্তটা রাজনৈতিকভাবে সরকারকে নিতে হবে। রাজনৈতিক কোনো দলকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে কি না-রাজনৈতিকভাবে যদি সরকার সিদ্ধান্ত নেয় তবে সেটা সম্ভব।
তিনি বলেন, তবে এখন আমাদের প্রধান ফোকাস হলো গ্রাউন্ড লেভেলে যারা অপরাধ করেছে, তাদের পেছনে দৌড়াচ্ছি। এই বিচারের পর যদি কোনো অঙ্গসংগঠনের বিচার সরকার করতে চায়, তাহলে সেগুলোর বিচার করা সম্ভব। এ বিষয়টিকে আমরা প্রাধান্য দিইনি। আমরা অপরাধের তদন্তের দিকে আগাচ্ছি এবং সেভাবে বিচার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, সমাজের নানা মানুষের নানা কথা শুনি, বিচার কেন তাড়াতাড়ি হচ্ছে না? একটা কথা মনে রাখতে হবে, এটা গণ-আদালতের বিচার নয়। বিচার একটা নিয়মকানুন মেনে করতে হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে সংঘটিত অপরাধ জটিলতম অপরাধ। এটার তদন্ত মানসম্মত উপায়ে করতে হলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সব জায়গায় গ্রহণযোগ্য বিচার করতে হয়, তদন্তগুলো নিখুঁত করতে হয়।
৫-৬ মাস সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তের জন্য যথেষ্ট নয় উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম বলেন, এই অসম্ভব কাজকে আমরা সম্ভব করার চেষ্টা করছি। আমাদের তদন্ত সংস্থা দিনরাত কাজ করছে। প্রসিকিউটররা দিনরাত পরিশ্রম করছে। জাতীয় প্রয়োজনীয়তার নিরিখে যে কাজ ৩ মাসে হওয়ার কথা, সেটা ১৫ দিনে করার চেষ্টা করছি।