সড়ক দুর্ঘটনায় এক বছরে ২১০২ নারী-শিশুর প্রাণহানি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১০:৩৮ পিএম
বিদায়ি বছর ২০২৩ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় দুই হাজার ১০২ জন নারী ও শিশু মারা গেছেন। নিহতদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা এক হাজার ১২৮ জন ও নারী ৯৭৪ জন। ওই বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ছয় হাজার ৯১১টি। এসব দুর্ঘটনায় মোট নিহত ছয় হাজার ৫২৪ জন এবং আহত ১১ হাজার ৪০৭ জন। দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ৩২.২১ শতাংশই নারী ও শিশু।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ২০২৩ সালের সড়ক দুর্ঘটনার বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে।
শনিবার রাজধানীর ধানমন্ডির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ওই বছর সড়ক দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ মানবসম্পদের ক্ষতি হয়েছে তার আর্থিক মূল্য ১৬ হাজার ৯১০ কোটির টাকার মতো। যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনার অনেক তথ্য অপ্রকাশিত থাকে, তাই আর্থিক ওই ক্ষতির পরিমাণ আরও ৩০ শতাংশ বেশি হবে।
সংবাদ সংম্মেলনে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ আই মাহাবুব উদ্দিন আহমেদ। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ১০টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। দুর্ঘটনা কমাতে ১০ দফা সুপারিশ করেন। তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্তদের অধিকাংশই দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ ও প্রায় ক্ষেত্রেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এই উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুর কারণে আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যায় এবং দুর্ঘটনায় আহত সদস্যকে সহায়-সম্পদ বিক্রি করে চিকিৎসা করতে গিয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সর্বস্বান্ত হচ্ছে। চিকিৎসার পরেও যারা পঙ্গু হচ্ছেন তাদের অবস্থা আরও করুন।
তিনি আরও বলেন, দেশের সড়ক পরিবহণ খাতে যে অব্যবস্থাপনা, চাঁদাবাজি ও নৈরাজ্য চলছে তা বন্ধ করতে হবে। এ বিষয়ে শুধু কমিটি গঠন এবং সুপারিশমালা তৈরির চক্র থেকে বেরিয়ে একটি টেকসই জনবান্ধব পরিবহণ কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। এজন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে গত পাঁচ বছরের দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা গেছে, প্রতি বছরই দেশে দুর্ঘটনা বাড়ছে। অবশ্য ২০২২ সালের তুলনায় গত বছর হতাহতের সংখ্যা কম ছিল। ২০২২ সালে দেশে ছয় হাজার ৮২৯টি দুর্ঘটনায় সাত হাজার ৭১৩ জন নিহত ও ১২ হাজার ৬১৫ জন আহত হন। অপরদিকে বিদায়ি ২০২৩ সালে ছয় হাজার ৯১১টি দুর্ঘটনায় ছয় হাজার ৫২৪ জন নিহত ও ১১ হাজার ৪০৭ জন আহত হয়েছেন।
শিশুমৃত্যু : প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাজার ১২৮ শিশু নিহত হয়েছে। তাদের ৩২৯ জনই বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রী ও চালক। রাস্তা পারাপার ও রাস্তা ধরে হাঁটার সময় যানবাহনের চাপায় বা ধাক্কায় নিহত হয়েছে ৫৩২ শিশু। মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী হিসাবে নিহত হয়েছে ২৬৭ শিশু। নিহত শিশুদের মধ্যে ২১৫ জনের বয়স এক মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী। ছয় বছর থেকে ১২ বছর বয়সি শিশু নিহত হয়েছে ৪৯২ জন। ১৩ বছর থেকে ১৮ বছর বয়সি শিশু নিহত হয়েছে ৪২১ জন। সড়কে শিশুমৃত্যুর হার বাড়ার বিষয়ে কয়েকটি কারণ উলেখ করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- দেশের সড়ক ও সড়ক পরিবহণ শিশুবান্ধব না হওয়া; সড়ক ব্যবহার সম্পর্কে শিশুদের মধ্যে সচেতনতার অভাব; পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সড়ক ব্যবহার সম্পর্কে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ না দেওয়া এবং অদক্ষ ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালক দিয়ে যানবাহন চালানো। এতে বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসার সময় ও বসতবাড়ির আশপাশের সড়কে খেলাধুলার সময় নিহতের ঘটনা বেশি ঘটেছে।
এক বছরে অন্যান্য দুর্ঘটনা : প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনার পাশাপাশি নৌ ও রেল দুর্ঘটনার তথ্যও উলেখ করা হয়েছে। বিদায়ি বছরে ১০৭টি নৌ দুর্ঘটনায় ১৪৮ জন নিহত, ৭২ জন আহত এবং ৪৬ জন নিখোঁজ রয়েছেন। ২৮৭টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ৩১৮ জন নিহত এবং ২৯৬ জন আহত হয়েছেন।
সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে বলা হয়েছে, আঞ্চলিক সড়কে সর্বোচ্চ দুই হাজার ৮৮৭টি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা মোট দুর্ঘটনার ৪১.৭৭ শতাংশ। এছাড়া দুই হাজার ৩৭৩টি (৩৪.৩৩ শতাংশ) জাতীয় মহাসড়কে, দুই হাজার ৮৮৭টি (৪১.৭৭ শতাংশ) আঞ্চলিক সড়কে, ৯৯৪টি (১৪.৩৮ শতাংশ) গ্রামীণ সড়কে ও ৫৮৩টি (৮.৪৩ শতাংশ) শহরের সড়কে দুর্ঘটনা ঘটে।
দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলা হয়, বিদায়ি বছরে ছয় হাজার ৫২৪ জন নিহতের মধ্যে দুই হাজার ৪৮৭ জনই মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী; যা মোট নিহতের ৩৮.১২ শতাংশ। এছাড়া ইজিবাইক, সিএনজিসহ থ্রি-হুইলার যাত্রী এক হাজার ২০৯ জন (১৮.৫৩ শতাংশ), বাসযাত্রী ২৭৪ জন (৪.১৯ শতাংশ), ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি আরোহী ৩৮৪ জন (৫.৮৮ শতাংশ)।
এতে আরও বলা হয়, দুর্ঘটনাগুলোর এক হাজার ২৯১টি (১৮.৬৮ শতাংশ) মুখোমুখি সংঘর্ষ, তিন হাজার ১৪৯টি (৪৫.৫৬ শতাংশ) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, এক হাজার ৪৪৬টি (২০.৯২ শতাংশ) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেওয়া, ৮১৭টি (১১.৮২ শতাংশ) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ২০৮টি (৩ শতাংশ) অন্যান্য কারণে ঘটেছে। দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ১১ হাজার ৩৬৬টি। এর মধ্যে বাস এক হাজার ৫০৩টি, ট্রাক এক হাজার ৮০৬টি, কাভার্ডভ্যান ২৮৩টি, পিকআপ ৪৩২টি, ট্রলি ১৭৮টি, লরি ১১৪টি রয়েছে।