করোনার টিকা সংগ্রহে বাংলাদেশকে কেন তৎপর হতে হবে?
ড. মোহাম্মাদ সরোয়ার হোসেন এবং ড. রেজাউল করিম
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২০, ১১:২৬ এএম
ছবি: এএফপি
করোনাভাইরাসের স্থবিরতা থেকে মুক্তি পেতে উন্মুখ হয়ে আছে পুরো বিশ্ব। কার্যকরী ভ্যাকসিন পৃথিবীকে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে বলে আমরা সবাই আশাবাদী।
নতুন একটি ভ্যাকসিন তৈরিতে সাধারনত ৫ থেকে ১০ বছর লাগলেও অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে এখন পর্যন্ত দুটি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ইমার্জেন্সি অনুমোদন পেয়েছে এবং আরো কয়েকটি সফলতার দ্বারপ্রান্তে। আশু মুক্তির আশায় শুরু হয়েছে কোভিড ভ্যাকসিন সংগ্রহের প্রতিযোগিতা।
ভ্যাকসিন আন্তর্জাতিকভাবে অনুমোদন পাওয়ার আগেই উন্নতদেশগুলো তাদের জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিমিত্তে ইতিমধ্যে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডোজ প্রি-অর্ডার অর্থাৎ কেনার চুক্তি করে ফেলেছে।
পৃথিবীর ৩৩টি দেশ (৫টি ধনী রাষ্ট্র এবং ২৭টি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশ) বিভিন্ন কোম্পানীর প্রায় ৫ বিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন ২০২১ সালের মধ্যে সংগ্রহ করা নিশ্চিত করেছে।
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার (৭.৫ বিলিয়ন) মাত্র ১৩ ভাগ মানুষ এই ৩৩টি দেশে বাস করে। কোনো কোনো দেশ পুরো দেশের জনসংখ্যার জন্য ভ্যাকসিনেশন করতে যত ডোজ প্রয়োজন তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি ডোজ কিনতে ইতিমধ্যে ম্যানুফ্যাক্টচারিং কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।
কোভিড ভ্যাকসিন সংগ্রহে অসম প্রতিযোগিতা
২০২১ সালে প্রথম সারির ১০টি ক্যান্ডিডেট ভ্যাকসিনের সম্ভাব্য উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১০ বিলিয়ন ডোজ। পুরো বিশ্বের ৭.৫ বিলিয়ন মানুষকে ভ্যাকসিনেশন করতে প্রয়োজন হবে ১৫ বিলিয়ন ডোজ (প্রতি জনে দুই ডোজ)। অসম প্রতিযোগিতার কারনে নিম্ন মধ্য এবং নিম্ন আয়ের ৯২টি দেশের কয়েক বিলিয়ন মানুষ কোভিডের ভ্যাকসিন থেকে বঞ্চিত হতে পার।
ডিউক গ্লোবাল হেলথ ইনোভেশন সেন্টার কর্তৃক পরিচালিত গবেষণা অনুসারে, অনেক নিম্ন-মধ্য ও নিম্ন-আয়ের দেশগুলিকে ভ্যাকসিনের জন্য ২০২২-২০০২ অবধি অপেক্ষা করতে হতে পারে, সুতরাং, বাংলাদেশকে তার টিকা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় COVID-19 ভ্যাকসিন ডোজ নিরাপদে অবিলম্বে কাজ করতে হবে জনসংখ্যা।
বাংলাদেশ কখন পর্যাপ্ত টিকা পেতে পারে?
সরকার সম্প্রতি সিরাম ইন্সটিটিউট, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন সংগ্রহের জন্য একটি চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী ৩ কোটি ডোজ বাংলাদেশে সরবরাহ করা হবে। সিরাম ইনস্টিটিউট আরও বেশ কয়েকটি দেশ এবং ওয়ার্ল্ড টাস্কফোর্সের (নাম কভ্যাক্স) সাথে চুক্তি করেছে। সেরাম ইনস্টিটিউটকে নিজের দেশের (ভারত) চাহিদা মেটাতে হবে। তাই প্রি-অর্ডার করা ৩ কোটি ডোজ সময়মত ডেলিভারি দিতে পারবে কিনা তা প্রশ্নাতীত। সিরামের ভ্যাকসিন দিয়ে মাত্র দেড় কোটি মানুষকে ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনা যাবে।
অন্যদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং গাভির মধ্যস্থতায় গঠিত কভ্যাক্স উদ্যোগটি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে ন্যায়সঙ্গত ভ্যাকসিন বিতরণের প্রাথমিক লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কভ্যাক্স এর উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিটি দেশে ২০২১ সালের মধ্যে জনসংখ্যার (উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী) শতকরা ২০ ভাগ মানুষকে ভ্যাকসিনেশন করার। এখন পর্যন্ত কভ্যাক্স মাত্র ৫০০ মিলিয়ন ডোজ প্রি-অর্ডার করেছে। দুর্ভাগ্যজনক অগ্রীম বুকিং প্রতিযোগিতার কারণে, কভ্যাক্স মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। তাই, প্রয়োজনীয় পরিমাণে ডোজ সংগ্রহের জন্য কভ্যাক্স উপর নির্ভর করা বোকামী হবে। তাই বাংলাদেশকে কালক্ষেপণ না করে ভ্যাকসিন সংগ্রহে অগ্রীম বুকিং গুরুত্বের সাথে নিতে হবে।
আগাম অর্ডার দেয়া প্রয়োজন কেন?
জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। তাছাড়া ‘কোভিড ভ্যাকসিন পাসপোর্ট’ নামক ইস্যু নিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় আলোচনা শুরু হয়েছে। কোভিট প্যান্ডেমিকের বিভীষিকা যাতে ফিরে না আসে, তাই উন্নত দেশগুলো সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবে। ভ্যাকসিনেশন ছাড়া বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা-বানিজ্য, চাকুরী, পড়াশুনা উপলক্ষে কয়েক মিলিয়ন মানুষের বিদেশে যাওয়ায় হুমকিতে পড়ে যেতে পারে যার প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। তাই ভ্যাকসিন সংগ্রহ/প্রি-অর্ডারে গরিমসি করলে পরে সম্ভবত আফসোস করতে হবে।
কোন ভ্যাকসিনগুলো সংগ্রহে বাংলাদেশকে টার্গেট করা উচিত?
যে ভ্যাকসিনগুলো উন্নত কোয়ালিটি, দামে কম এবং দেশের আবহাওয়া সংরক্ষণ করা তুলনামূলক সহজ হতে পারে সেগুলো সংগ্রহে জোর দিতে হবে। বিভিন্ন প্রযুক্তির ভ্যাকসিন রয়েছে-
এমআরএনএ ভ্যাকসিন: এই প্রযুক্তিটি ব্যবহার করে, বায়োনেটেক-ফাইজার এবং মডেরেনা-এনআইএআইডি এর ভ্যাকসিনগুলি গ্রহণযোগ্য কার্যকারিতা এবং সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বিধায় ইমার্জেন্সি অনুমোদন পেয়েছে । তবে এগুলো সংরক্ষণ করতে অত্যন্ত নিম্ন (মাইনাস ৭০-২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস) তাপমাত্রায় রাখতে হয়। এই ধরনের (আল্ট্রা) কোল্ড স্টোরেজ পদ্ধতি মেইনটেইন করার জন্য বাংলাদেশের টিকা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে অনেক বেগ পেতে হবে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন বিষয় হচ্ছে - বিশ্বস্বাস্থ্যর সংস্থা ডাটা অনুযায়ী মাঠ পর্যায়ে নিয়মিত তাপমাত্রা (২-৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস) বজায় না রাখার কারণে বিশ্বব্যাপী ৫০% এর বেশি ভ্যাকসিন নষ্ট হয়। তদুপরি, এই ভ্যাকসিনগুলি তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল।
উদাহরণস্বরূপ, মডেরনা-এনআইএআইডি-র ভ্যাকসিনের জনপ্রতি ৭৪ মার্কিন ডলার ব্যয় হবে। সুতরাং, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সরকারী উদ্যোগে এই ভ্যাকসিনগুলি সংগ্রহে জোর দেয়া উচিত হবে না তবে সাধারন তাপমাত্রায় (২-৮ ডিগ্রী) সংরক্ষণ করা যায় এমন এমআরএনএ টেকনোলজির ভ্যাকসিন কিউরভ্যাক নামক একটি কোম্পানী ডেভেলোপ করেছে যা ২০২১ সালে জরুরী ব্যবহারের অনুমোদন পেতে পারে। এটির দামও (২০ ইউরো) বিবেচনায় নিতে হবে।
অ্যাডেনোভাইরাল ভ্যাকসিন: এই ভ্যাকসিন প্রযুক্তির ভ্যাকসিন এফডিএ এবং ইএমএ অনুমোদন দিয়েছে । উদাহরণস্বরূপ, জনসান ফার্মাসিউটিক্স (জনসন এবং জনসন) যে প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে তা ২০২০ সালে ইবোলা ভ্যাকসিনের জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অনুমোদন পেয়েছে। তদুপরি, স্ট্যান্ডার্ড স্টোরেজ তাপমাত্রা, অপেক্ষাকৃত কম দাম এবং বিপুল পরিমাণে উৎপাদনের দক্ষতার কারণে, বাংলাদেশকে প্রি-অর্ডার দিতে বিবেচনা করতে পারে। পাশাপাশি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের সংগ্রহ আরো প্রি-অর্ডার দেওয়ার পাশাপাশি স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিনেরও বিবেচনা করা যেতে পারে।
প্রোটিন সাব-ইউনিট: এই ভ্যাকসিন প্রযুক্তি এফডিএ এবং ইএমএ অনুমোদন পেতেও সফল প্রমাণিত হয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, নোভাভ্যাক্সের ভ্যাকসিন প্রার্থী এখনও অবধি গ্রহণযোগ্য কার্যকারিতা এবং সেইফটি প্রোফাইল দেখিয়েছে। এছাড়াও নোভাভ্যাক্স ভ্যাকসিন তুলনামূলক সস্তা এবং স্ট্যান্ডার্ড স্টোরেজ তাপমাত্রার কারণে বাংলাদেশের এই ভ্যাকসিনের প্রি-অর্ডারিংয়ের বিষয়টিও বিবেচনা করা উচিত।
নিষ্ক্রিয় প্রযুক্তির টিকা (Inactivated vaccines): এটি লক্ষণীয় যে ইইউতে বৈজ্ঞানিকভাবে উন্নত দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের মতো দেশগুলির কোনওটিই নিষ্ক্রিয় ভ্যাকসিনে বিনিয়োগ করেনি । একইভাবে, ভারত বায়োটেক, সিনোভাক, সিনোফর্ম, এবং অন্যান্য নিষ্ক্রিয় প্রযুক্তির টিকাগুলোতে বিনিয়োগ করা উচিত হবে না। এই নিষ্ক্রিয় প্রযুক্তির ভ্যাকসিনগুলি কার্যকারিতাও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। তাছাড়া এগুলো দামও বেশী। প্রসংগত, সিনোভাকের ভ্যাকসিনের জন্য জনপ্রতি ৬০ ডলারের মত ব্যয় করতে হবে।
পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন সংগ্রহে বাংলাদেশে তাৎক্ষণিকভাবে কী কী করা উচিত?
১। ভাল কোয়ালিটির কিন্তু দাম কম এবং সাধারন তাপমাত্রায় (২-৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস) সংরক্ষণ করা যায় এমন অগ্রগামী ভ্যাকসিন কেন্ডিডেটগুলো প্রাক-অর্ডার করতে কালবিলম্ব না করা। সঙ্গত কারনে জেনসেন, কিউওরভ্যাক, নোভাভ্যাক্স, স্পুটনিক-৫ ভ্যাকসিনগুলো আগাম বুকিং দেয়া প্রয়োজন।
২। বেসরকারি উদ্যোগে ভ্যাকসিন সংগ্রহে গুরুত্ব দেয়া : সরকারী অনুদানযুক্ত টিকা কর্মসূচির মাধ্যমে পুরো দেশে ভ্যাকসিন করতে প্রায় ২০২৩-২০২৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। যাদের সমর্থ আছে তারা যেন বেসরকারী উদোগের টিকা নিতে পারে সেজন্য সরকারকে উদ্যোগ নেয়া উচিত। দেশের প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ বেসরকারি হাসপাতাল / ক্লিনিকগুলিতে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেন। তাই জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বেসরকারী উদ্যোগ থেকে টিকা নেয়ার সমর্থ রাখে। তাই, সরকার এক্ষেত্রে ফার্মাসিউটিক্যাল বা যেকোন বেসরকারী উদ্যোগে ভ্যাকসিন সংগ্রহের নীতি-নৈতিকতা, পলিসি বাতলিয়ে দিতে পারে।
৩। স্বল্প সময়ের মধ্যে পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন পেতে ফিল-ফিনিস/বোতলজাতকরন পদ্ধতিতে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া উচিত। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং মানসম্মত কোয়ালিটি নিশ্চিত করতে পারে এমন ফিল-ফিনিস প্ল্যাটফর্মকে কাজে লাগানো। এক্ষেত্রে সরকারী মধ্যস্থতায় বিভিন্ন ভ্যাকসিন কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে পারলে পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন সংগ্রহের বড় বাধা দূর হতে পারে।
৪) আন্তর্জাতিকভাবে ভ্যাকসিনের ন্যায়সঙ্গত বন্টন আন্দোলনে বাংলাদেশকে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে হবে। এজন্য বিভিন্ন ফোরামে সোচ্চার হতে হবে।
লেখক:
ড. মোহাম্মাদ সরোয়ার হোসেন, জনস্বাস্থ্য গবেষক এবং নির্বাহী পরিচালক, বায়োমেডিকেল রিসার্চ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ, প্রাক্তন সিনিয়র ম্যানেজার (আরএনডি), ইনসেপ্টা বায়োটেক, বাংলাদেশ
ড. রেজাউল করিম, ইমিউনোলজিস্ট এবং বিশেষজ্ঞ-ড্রাগ ডেভেলোপমেন্ট এন্ড রেগুলেটরি এফেয়ারস, WHO-Utrecht Centre of Excellence for Affordable Biotherapeutics, The Netherlands এর প্রাক্তন প্রজেক্ট লিডার; সায়েন্টিস্ট, বায়োমেডিকেল রিসার্চ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ