Logo
Logo
×

কোভিড-১৯

করোনায় কোরবানি: বিকল্প চিন্তার ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি

Icon

ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক, মুহাম্মদ মোস্তফা হোসাইন শাহীন

প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০২০, ০৮:৪০ পিএম

করোনায় কোরবানি: বিকল্প চিন্তার ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি

ছবি: সংগৃহীত

করোনা জীবনের বিভিন্ন বিভাগের মত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় ব্যপক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। আসন্ন যিলহজ মাসের সঙ্গে ইসলামের অন্যতম ইবাদত হজের পাশাপাশি কোরবানির বিষয়টিও জড়িত। 

কোরবানি ইসলামের অন্যতম একটি শিআর বা প্রতিক। কোরবানি সক্ষম ব্যক্তির উপর ওয়াজিব কিংবা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। ব্যক্তি কোরবানির দিবসেও সক্ষমতার অধিকারী হলে তাকে বিধানটি পালন করতে হবে। 

কোরবানির সঙ্গে প্রান্তিক মানুষদের জীবন-জীবিকার প্রশ্ন রয়েছে। সামান্য কিছু মুনাফা অর্জন করার আশায় তারা বছরব্যাপি পশু পালন করেন। অন্যদিকে সারা বছর গোশত ক্রয়ে অক্ষম দরিদ্র মানুষেরা কোরবানির জন্য দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকে। 

দেশের চামড়া শিল্প কেন্দ্রিক অর্থনীতি কোরবানি নির্ভর। ইসলামে কোন ইবাদত রহিত করার উদাহরণ পাওয়া যায়না; বরং বিকল্প পদ্ধতিতে সেসব ইবাদত পালন করার নজির রয়েছে। 

কোরবানি বাস্তবায়নে বিভিন্ন দেশে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠলেও আমাদের দেশে হাটে গিয়ে পশু ক্রয় এবং দলবদ্ধ হয়ে সেটি জবাই করা এখন পর্যন্ত একমাত্র রীতি। 

তাছাড়া এখানে পশুর নিরাপদ কেনা-বেচার জন্য উন্নত বিশ্বের মত ‘লাইভস্টোক মার্কেট’ যেমন নেই, তেমনি নিরাপদ জবাই ব্যবস্থাপনা হিসেবে ‘পাবলিক এবাট্রর’ গড়ে উঠেনি। ফলে করোনার সংকটকালীন সময়ে ক্রেতা-বিক্রেতা স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও জবাই ব্যবস্থাপনায় সনাতন পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় কৌশল অবলম্বন পরিস্থিতির একান্ত দাবী।

‘ফিকহুল ওয়াকি’ তথা পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ইসলামী শরীয়তের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রসিদ্ধ নীতি। 
পরিস্থিতির আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রতি উদ্ধুদ্ধ করে আল্লাহ তাআলা বলেন, হে মু’মিনগণ, তোমরা সতর্কতা অবলম্বন কর (নিসা:৭১)। 

এখানে সতর্কতার কথা মূলত শত্রু ও বিপদের মাত্রা নির্ণয়ের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে শত্রুর অবস্থার আলোকে তোমাদের উপর সম্ভাব্য যে নেতিবাচক পরিস্থিত তৈরী হতে পারে, সে অনুযায়ী তোমরা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ কর। 

আল্লাহ বলছেন, তোমরা মানুষেদেরকে প্রজ্ঞা এবং উত্তম নসীহতের সঙ্গে ইসলামের দিকে আহবান করো; আর সুন্দর যুক্তিতে তাদের যুক্তিগুলো খন্ডন কর (নাহল: ১২৫)।  এখানে প্রজ্ঞা দ্বারা মূলত পরিস্থিতির আলোকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপকেই বুঝানো হয়েছে। 

হাবশা এবং মদীনায় দুটো হিজরতই ছিলো মূলত উদ্বুত পরিস্থিতি কেন্দ্রিক। মক্কার প্রাথমিক দিনগুলোতে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও বিশ্বাসগত নৈকট্যের কারণে মুসলিমরা রোমান পরাশক্তিকে সমর্থন করতেন আর কুরাইশরা পারস্য পরাশক্তিকে সমর্থন করতেন। 

মদীনায় হিজরত পরবর্তী সময়ে নবীজী (সা.) পরিস্থিতি অনুযায়ী অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। মদীনার সনদ এবং হুদাইবিয়া সন্ধি পরিস্থিতির আলোকে সিদ্ধান্ত নেয়ার বাস্তব উদাহরণ। 

মুয়ায ইবন জাবালকে (রা.) ইয়েমেনের প্রশাসক নিযুক্ত করার সময় নবীজী (সা.) কোরআন ও সুন্নাহতে কোন বিষয়ের সমাধান না পাওয়া সাপেক্ষে পরিস্থিতির আলোকে সিদ্ধান্ত নেয়ার অনুমতি দিয়ে ছিলেন (মুসনাদে আহমাদ)। এটাই মূলত ফিকহুল ওয়াকি‘ বা পরিস্থিতিগত ফিকহ। 

যে কোন কঠিন পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করার ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী খুবই জনবান্ধব। ক্বাওয়ায়িদুল ফিকহে যেটি ‘কাঠিন্যতা সহজতার পথকে উম্মুক্ত করা’ ও ‘সংকীর্ণতা প্রশস্ততাকে অগ্রাধিকার দেয়’ নীতির অধীনে পড়ে। 

সুতরাং ক্বাওয়েদুল ফিকহের আলোকে করোনাকালীন কোরবানি বিধান বাস্তবায়নে ক্রেতার জন্য সহজতর পথ উম্মুক্ত করে দেয়ার অর্থ ঝুঁকিমুক্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষার মাধ্যমে তার পশুটি বিক্রির ব্যবস্থা করে দেয়া। 

আর বিক্রেতার জন্য সহজতর পথ উম্মুক্ত করার অর্থ হচ্ছে তার স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা সাপেক্ষে কোরবানির পশু ক্রয় ও কোরবানি আদায়ে বিকল্প পথের সন্ধান দেয়া। 

বাস্তবপক্ষে আমাদের হাট ও জবাই ব্যবস্থাপনা দুটোই ঝুঁকির কাজ। পরিস্থিতি অনুযায়ী সরাসরি হাটে না গিয়ে অনলাইনে কিংবা খামার থেকে পশু ক্রয়-বিক্রয় করা যায়। 

পশুর বাস্তব ছবি ও যৌক্তিক মূল্য, পশুর নির্দিষ্টায়নে কিউআর কোড ব্যবহার, ক্রেতা-বিক্রেতার সম্মতি, পশু ও মূল্য হস্তান্তর, পশুর পরিবহন খরচ ও ক্রেতার পছন্দের ইখতিয়ার ইত্যাদি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে অন-লাইন পদ্ধতিতে পশু ক্রয়-বিক্রয় করে স্বাস্থ ঝুঁকি এড়ানো যায়। 

খামারভিত্তিক কেনা-বেচার ক্ষেত্রে খামারের নির্দিষ্ট হটলাইনে যোগাযোগ করে দৈনন্দিন ভিত্তিতে ক্রেতার জন্য সময় নির্ধারণ এবং খামারে ক্রেতার সংখ্যা সীমিতকরণ করা সম্ভব। 

খামার কর্তৃপক্ষ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ক্রেতার কাছে পশু পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারে কিংবা খামারে জবাই করার ব্যবস্থা রাখতে পারে। পশু জবাইয়ের দিন পর্যন্ত তা রক্ষনাবেক্ষণ করতে যে পরিমাণ খরচ হবে সেটি ক্রেতা বহন করবে কিংবা পশু বিক্রির সময় খামার কতৃপক্ষ প্রাক্যলিত খরচ পশুর মূল্যের সাথে সমন্বয় করে নিবে। 

পরিবেশবান্ধব এবং সুবিধাজনক হওয়ায় এ পদ্ধতিটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খুবই জনপ্রিয়।

শহর এলাকায় সরাসরি হাটে গিয়ে পশু কিনতে হলে ক্রেতা এবং বিক্রেতা সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে নাম নিবন্ধন করবে। ক্রেতাদের নির্দিষ্ট টোকেন প্রদান করে সামাজিত দূরত্ব বজায় রাখার আনুপাতিক হারে হাটে যাওয়ার অনুমোদন দেয়া যেতে পারে। 

দৈনিক নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্রেতাকে বাজারে প্রবেশের অনুমতি দেয়া যেতে পারে এবং যাতে করে কেউ বারংবার বাজারে যেতে না পারে সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। 

এই পদ্ধতিটি বাস্তবায়ন করার জন্য ওয়ার্ড ভিত্তিক ছোট পরিসরে পশু হাট ব্যবস্থাপনা করতে পারলে এক এলাকার অধিবাসীরা অন্য এলাকায় যাওয়ার প্রয়োজন পড়বেনা। 

গ্রামভিত্তিক বাজার ব্যবস্থাপনা আর একটি বিকল্প পদ্ধতি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে গ্রামের প্রান্তিক চাষীদের পশুগুলো সে গ্রামেরই কোরবানি দাতারা কিনে নিবে। তবে একই গ্রামে যদি প্রয়োজনীয় সংখ্যক পশু পাওয়া না যায়, তাহলে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণে সামাজিক দূরত্ব বজায় নিশ্চিত করে অনূর্ধ পাঁচটি গ্রাম নিয়ে ছোট পরিসরে হাট বসানো যেতে পারে। 

এ ক্ষেত্রেও মসজিদ ও ওয়ার্ড ভিত্তিক অগ্রিম তালিকা তৈরী করে গ্রাম ভিত্তিক হাটে যাওয়ার সময় ও দিন নির্ধারণ করে দেয়া যেতে পারে ।

জবাই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার স্বার্থে সিটি করর্পোরেশন বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোরবানি জবাই ও বন্টম টিম গঠন করা যেতে পারে। 

পশু জবাইয়ের আধুনিক মেশিন ব্যবহার একটি যুগোপযুগী পদ্ধতি হতে পারে। সিটি কর্পোরেশন এলাকা ভিত্তিক মেশিন প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি ব্যবহার করে সেবাটি চালু করতে পারে। 

সহজ ও কম সময়ে অনেক বেশী সংখ্যক পশু জবাইয়ের সেবাটি প্রদান করলে অনাকাংখিত লোকসমাগম এড়ানো সহজ হবে। চাপ এড়ানোর জন্য একদিনে সব পশু জবাই না করে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক পশু জবাই হারে কোরবানির দিনগুলোতে সব পশু জবাইয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। 

ইতিমধ্যে মজুরির বিনিময়ে ঢাকায় পশু জবাই ও কাটার কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা খুবই ইতিবাচক পদক্ষেপ। এটি গ্রাম কেন্দ্রিকও প্রচলন করা যেতে পারে। দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো এ সেবায় এগিয়ে আসতে পারে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন শহর ও গ্রামের সর্বত্র সমান পরিস্থিতি নয়। শহরে যারা কোরবানির ব্যবস্থা করতে সক্ষম নয়, তারা গ্রাম কিংবা সুবিধাজনক স্থানে কোরবানির অর্থ পাঠিয়ে দিতে পারেন। 

কেবল কোরবানির দিনগুলো শেষ হয়ে যাওয়ার পরও কেউ কোরবানি করতে ব্যর্থ হলে পশু ক্রয়ের জন্য বরাদ্ধকৃত অর্থ দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অসহায় প্রতিবেশীদের মাঝে বন্টন করতে পারবেন। 

দেশের নিম্ন ও মধ্যবৃত্তের আর্থিক সংগতির সুরক্ষা দিতে প্রয়োজনে পূর্বের বছরগুলোর অনুরূপ পরিমাণ কোরবানীর বাজেটে রেখে তার কিছু অংশ দিয়ে কোরবানি ও বাকী অংশ সাদাকাহ করতে পারে। 

ইসলামে কোরবানি একটি দরিদ্রবান্ধব ইবাদত। কোরবানির পশু বিক্রি করে দরিদ্ররা যেমন আর্থিক স্বচ্চলতা অর্জন করে, তেমনি গোশত থেকে শারীরিক পুষ্টি লাভ করে। 

কোরবানি ধনী-গরীবের মাঝে অর্থ প্রবাহে আবর্তন সৃষ্টি করে। ধনীদের উচিত প্রান্তিক মানুষের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করে ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠনে এগিয়ে আসা। কোরবানি জন্য পশু ক্রয়  সে প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণের নামান্তর। 

স্মতব্য যে, কোরবানির কোন বিকল্প নেই। তাই কোরবানি নিশ্চিত করে পাশাপাশি ব্যাপকহারে দান-সাদাকাহ করা এ সময়ের একান্ত দাবী।

উপরোল্লেখিত বিকল্প পদ্ধতি সমুহ অবলম্বন করে করোনাকালীন সময়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেও কোরবানির বিধান বাস্তবায়ন করা সম্ভব। 

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও আপামর মুসলিম ইসলামের বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করে পরিস্থিতি অনুযায়ী কোরবানির বিধান পরিপালন করতে পারে।

 

লেখক: ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক, সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ ও মুহাম্মদ মোস্তফা হোসাইন শাহীন, পিএইডডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব মালায়া, মালয়েশিয়া

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম