লকডাউন কড়া আর শিথিলের খেলা
করোনাকালে হার্ড ইমিউনিটি আর অনিশ্চিত ভবিষ্যত

কাকন রেজা
প্রকাশ: ০৮ মে ২০২০, ০৯:০৯ এএম

কী লিখব, এমনটা ভেবে ভয়াবহ রকমের কনফিউজড। পুরোপুরি বিভ্রান্ত। কোন হিসাবই মিলছে না, মিলছে না অঙ্কের সূত্র। করোনায় আক্রান্ত হলে শরীরে অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দেয়। এই স্বল্পতার কারণে অনেক সময় মানুষ আবোলতাবোল বকে, নানা অদ্ভুত কর্মকাণ্ড করে। আমাদের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রক সিস্টেম তেমন অক্সিজেন স্বল্পতায় ভুগছে কিনা সে প্রশ্নে কনফিউশন, বিভ্রান্তি।
প্রশ্ন করার আগেই বলছি, আমাদের সংক্রমণ যখন বাড়ছে তখন আমরা লকডাউন শিথিলের সিদ্ধান্ত নিলাম। পোশাক কারখানা চালু করলাম। যার আড়ালে অনেক কারখানাই চালু হয়ে গেল। দোকানপাট খোলার সিদ্ধান্ত হলো। বলা হলো সীমিত আকারে। আকার যে সীমিত রাখা সম্ভব হয় না তা জেনেও এমন ঘোষণা হলো।
সারাবিশ্বের দিকে তাকাই। সংক্রমণ যখন সর্বোচ্চ চুড়ায় ওঠার পর নিম্নগামী হলো, তখন উন্নত বিশ্ব লকডাউন শিথিল করার ঘোষণা দিয়েছে। তাও কিছু দিক নির্দেশনাসহ। এ ব্যাপারে জার্মানে বসবাসরত একজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিলো। জার্মানও লকডাউন কিছুটা শিথিল করতে চলেছে। তিনি জানালেন, সরকার মানুষের সামাজিক দূরত্বটা মেনে চলা এবং মাস্ক পড়াটাকে বাধ্যতামূলক করেছে।
আর সেখানকার মানুষ আইন মেনে চলতে অভ্যস্ত বলে সেভাবেই তারা জীবনযাপন প্রণালীকে নতুন করে সাজিয়েছেন। গণপরিবহণ চলছে সেখানে এবং সীমিত আকারটা ধরে রেখেই। তবে সেই গণপরিবহণে মাস্ক ছাড়া কেউ নেই। শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব মেনেই তারা কাজকর্ম শুরু করছে। উন্নত দেশগুলোর প্রতিটাই প্রায় একইরকমভাবে জীবনের ছন্দে ফেরার চেষ্টা করছে।
ছন্দে ফেরার পেছনে তাদের বড় কারণ হচ্ছে সঠিকভাবে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও সমন্বয়ের ব্যবস্থা করা। তারা প্রচুর টেস্ট করেছে। যা হয়তো আমাদের কল্পনাতেই নেই। সেই টেস্টের কারণে তারা জানতে পেরেছে সংক্রমণের প্রকৃত চিত্রটা কী। সেই চিত্র দেখেই তারা তাদের প্ল্যান দাঁড় করিয়েছে। আর সে অনুযায়ী তারা পর্যায়ক্রমে লকডাউন শিথিলের পথে যাচ্ছে।
এক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা কী, আমাদের টেস্ট কী পরিমাণ। এখন টেস্ট হচ্ছে প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ হাজারের মধ্যে। পরিকল্পনা রয়েছে এ সংখ্যা বাড়িয়ে ১০ হাজার করার। ১৬ কোটি কারো মতে ১৮ কোটি জনসংখ্যায় পৌঁছে যাওয়া একটি দেশে প্রতিদিনের ১০ হাজার টেস্ট প্রকৃত চিত্র কতটা সামনে আনবে, এমন প্রশ্নটা সবার।
দ্রুত টেস্ট করার জন্য প্রয়োজন র্যাপিড টেস্টিং কিট। সে কিট নিয়ে কী হচ্ছে তাতো সবারই জানা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ব্যবহার করছে এই কিট। সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা স্বত্বেও ভারত আমাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু, তাদেরকেও ফলো করতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। খবরে দেখলাম ভারত ভ্রাম্যমাণ পরীক্ষা কেন্দ্র চালু করেছে পরীক্ষার পরিধি বাড়ানোর জন্য, আর আমরা এখন কিট প্রশ্নেই খাবি খাচ্ছি।
সুতরাং কনফিউশনের প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক এবং বিভ্রান্তি থাকাটাও। বলা হচ্ছে লকডাউন কঠোরভাবে মানার কথা। আবার দোকান, শপিং মল খুলে দেয়া হচ্ছে। খোলা নিয়ে প্রশ্ন থাকতো না, যদি আমাদের সামাজিক সংক্রমণ শুরু না হত বা সামাজিক সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ করা যেত। সে অবস্থায় অন্য এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে আভ্যন্তরীণভাবে লকডাউন শিথিলের ব্যবস্থা নেয়া যেত।
অবস্থা অনুযায়ী রেড, অরেঞ্জ, গ্রিন জোন হিসাবে আক্রান্ত এলাকাগুলোকে ভাগ করা জরুরি ছিল। যেমনটা করেছে অন্যান্য দেশগুলো, এমনকি ভারতও। সে অনুযায়ী লকডাউন শিথিলসহ গণপরিবহণ চালুর ব্যবস্থা করা পর্যন্ত সম্ভব হতো। আমাদের সে রকম কোন সমন্বয় বা পরিকল্পনা কিছু নেই বললেই চলে। উল্টো গণমাধ্যমগুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইইডিসিআর এর মধ্যে দ্বন্দ্বের কথা বলছে।
আইইডিসিআর ইতোমধ্যে বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহের কাজ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে এখন বাধ্য হয়েই আমাদের হার্ড ইমিউনিটির চিন্তা সমুখে চলে আসছে। বিবিসি’র সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেশের অন্যতম ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম একই কথা বলেছেন। যেহেতু আমরা কার্যকরভাবে লকডাউন করতে পারিনি। তারপর কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।
প্রথমত বিদেশি ও বিদেশ প্রত্যাগতদের দেশে ঢুকতে দেবার ব্যাপারে আরও কঠোর হওয়া উচিত ছিল, যা হয়নি। ফলে তারা অনেকটা বিনা বাধাতেই দেশে ঢুকেছেন। তারপর লকডাউন না করেই সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ঢাকা থেকে ঈদের ছুটির মত মানুষ গ্রামে ছুটে গেছেন। ভাইরাসের দেশব্যাপী বিস্তার ঘটেছে। পরবর্তীতে আবার তাদের ঢাকায় ডেকে আনা হয়েছে।
দ্বিতীয় দফা বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং ভাইরাস সেই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়েছে। ঢাকার বর্তমান সংক্রমণের হার অন্তত তাই বলে। এই যে ঘটনাগুলো তা সবারই জানা। এসব নিয়ে কথাও হয়েছে বহুবার। তবু এই বিতর্কগুলো বা ভুলগুলো শোধরানোর কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং ভুলগুলোকে বাড়তে দেয়া হয়েছে।
এই ভুলের মধ্যে যোগ হয়েছে লোক দেখানো ত্রাণ কার্যক্রমের। এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও এর আগে সামাজিক কোন দূরত্ব না মেনেই লোক জমায়েত করে ত্রাণের নামে ফটোসেশন চলেছে। যা ভাইরাস বিস্তারে ভূমিকা রেখেছে। এখন ফটোসেশন চলছে ধান কাটার। গণ ও সামাজিকমাধ্যম পরিষ্কার করেছে এসব ধান কাটার বেশিরভাগই ছিল শুধুমাত্র ফটোসেশন এবং তা সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব না মেনেই।
এখান থেকেও ভাইরাসের আরেক দফা বিস্তারের সুযোগ হয়েছে। এসবের ফলে কী হয়েছে, নগর পুড়লে যে দেবালয় বাদ যায় না, তা পুনর্বার প্রমাণিত হয়েছে। একজন বর্তমান ও একজন সাবেক সংসদ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। জেলা প্রশাসকরাও রয়েছেন আক্রান্তের মধ্যে। রয়েছেন পুলিশের কর্মকর্তাগণ। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, এসিল্যান্ড আর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তো রয়েছেন আগে থেকেই।
অপরদিকে সারাদেশে বিস্তারের ফলে হঠাৎ করেই এই যুদ্ধে মুখোমুখি হয়েছেন চিকিৎসকরা। প্রস্তুত হবার আগেই তাদের হঠাৎ যুদ্ধে নামিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তা হয়েছে ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই। যার ফলে এই সম্মুখ যোদ্ধাদের অনেকেই আজ করোনায় আক্রান্ত। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটা অংশ আজ নিজেই রোগী।
বিবিসি’র সঙ্গে সাক্ষাতকারে ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলামের মূল কথা হচ্ছে, এখন পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছে যখন হার্ড ইমিউন গড়ে তোলা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। হার্ড ইমিউন গড়তে অন্তত ৭০ ভাগেরও বেশি মানুষের আক্রান্ত হতে হবে। অর্থাৎ কেউ আর বাদ থাকবে না। এরমধ্যে যারা বেঁচে থাকার মত শারীরিক সক্ষমতা ধরেন তারা বেঁচে থাকবেন অন্যরা মারা যাবেন।
হার্ড ইমিউনের এমন চিন্তা হচ্ছে মানুষকে একরকম ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া। কেউ একে বাঁকাভাবে গণহত্যার চিন্তাও বলতে পারেন। এমন যদি কেউ চিন্তা করে থাকেন, তবে তারাও যে মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাবেন তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।
সামর্থ্যবানরা যদি ভাবেন, আমাদের সামর্থ্য রয়েছে আমরা চিকিৎসা সুবিধা পাব। এমন ধারণা মহা ভুল। বিদেশমুখি হবার রাস্তা বন্ধ। দেশে বেসরকারি হাসপাতালে যে কয়টা আইসিইউ রয়েছে তার খরচ জোগাবার মত সারাদেশে অসংখ্য নব্যধনী রয়েছেন। দুর্নীতির টাকায় যারা ফুলে ফেঁপে উঠেছেন। রয়েছেন বেশুমার ক্ষমতাবান।
দেশে এখন কে যে কার থেকে ক্ষমতাবান তা বোঝা মুশকিল। যারা ভাবছেন, তারা আইসিইউ’র দখল নেবেন, তা অত সহজ হবে না। পরিস্থিতি খারাপ হলে সেখানেও যুদ্ধ হবে, ক্ষমতা আর অর্থের যুদ্ধ। আর সে যুদ্ধ শুধু আইসিইউ দখলেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, গড়াবে অনেক দূর।
শেষ করার আগে, যারা কথায় কথায় সব কিছুর জন্য দেশের সাধারণ মানুষদের দায়ি করেন তাদের বলি। লকডাউন কী জিনিস তা না বোঝাতে পারার ব্যর্থতাটা কার? তাও কি সাধারণ মানুষদের? আপনিও কি বোঝেন লকডাউন কাকে বলে? নিজেকে প্রশ্ন করুন তো। লকডাউন না করে ছুটি ঘোষণার মাহাত্ম্যটা কি বোঝাতে পারবেন? জানি, পারবেন না।
চীন যেভাবে লকডাউন কার্যকর করেছে সেভাবে কি আমরা পেরেছি? পারিনি। এর কারণ হলো লকডাউন সম্পর্কে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রেরও ভালো ধারণা ছিল না। যার ফলে মানুষকেও পরিষ্কারভাবে বোঝানো যায়নি লকডাউনটা আসলে কী। কার্ফু যে অর্থে সাধারণ মানুষ বোঝে সে অর্থে লকডাউনটা তাদের জন্য পুরোপুরি একটি নতুন শব্দ আর বিষয়। সুতরাং সাধারণ মানুষকে দোষ দেয়াটা নেহাতই অনর্থক।
এসবের পরেও লকডাউন ব্যর্থ হবার মূল কারণ হচ্ছে দরিদ্রতা। মানুষ পেটের ক্ষুধায় লকডাউন ভাঙতে চেয়েছে। তারা করোনা হলে মারা যেতে পারেন জেনেও পেটের দায়ে পোশাক কারখানায় কাজে যোগ দিয়েছেন। রিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। এই মানুষগুলো ক্ষুধা নিবারণের নিশ্চয়তা পেলে ঘরবন্দী থাকতো।
ভারত শ্রমিক ও দরিদ্র মানুষদের জন্য ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। পাকিস্তানও খুব একটা পিছিয়ে নেই, তাদের সহায়তা প্যাকেজ ১ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকার মত। বিপরীতে আমাদের কত? যাক সেটা আর উল্লেখ করতে চাই না। তবে আপনারা খুঁজে-পেতে হিসাব করে দেখুন তো আমাদের শ্রমিক ও দরিদ্র মানুষের সেই বরাদ্দ দিয়ে দুই থেকে চারদিনের বেশি চলে কিনা।
যদি না চলে সঙ্গতই তাদের কাছে লকডাউন কথাটি অর্থহীন হয়ে উঠবে। বিষয়টি হিসাবে রাখুন তাহলে অনেক অঙ্কই মিলে যাবে। এরপরও যারা আমাদের দেশের অসহায় মানুষগুলোকে দোষ দিতে চান, তারা নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তির বিষয়টিও ভেবে দেখতে পারেন। এর উত্তরে হয়তো বলবেন, এমন দিনেও যারা ঘুরতে বেরোয়, চা খেতে যায়, তারা কী। বলি, তারা আপনাদেরই ভাই বেরাদর, আপনাদেরই সন্তান।
তাদের কারো গাড়ি, কারো মোটরবাইক, নিদেনপক্ষে সাইকেল রয়েছে। তাদের বাড়িতে অন্তত দু’বেলা খাবারের নিশ্চয়তা রয়েছে। এরা আপনাদেরই স্বজন। পেটে ক্ষুধা থাকলে আড্ডা মারার মানসিকতা থাকে না। অতএব আমাদের সহজসরল মানুষগুলোকে দোষী সাব্যস্ত করার আগে আয়নায় নিজের মুখটা দেখে নিন।
সুসজ্জিত কক্ষে বসে, ফেসবুক লাইভে মানুষকে ঘরে থাকতে বলাটা খুব সহজ। আপনার ঘরেই যদি খাদ্য সরবরাহের চেইনটা বন্ধ করে দেয়া যায় বা খাবার ফুরিয়ে যায়, আপনাকেই সবার আগে নিশ্চিত পথে পাওয়া যাবে।
লেখক: কাকন রেজা, সাংবাদিক ও কলামিস্ট