পাহাড়ে উৎসববিহীন বিজু উৎসব

সুশীল প্রসাদ চাকমা, রাঙ্গামাটি
প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২০, ০৬:১১ পিএম

পাহাড়ে উৎসববিহীন বিজু উৎসব
বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ সংক্রমণ আতঙ্কের মধ্যে শুরু হয়েছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর তিন দিনব্যাপী উৎসববিহীন বিজু।
রোববার পালিত হয়েছে ফুলবিজু। সকালে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই মহান সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে পানিতে ফুল ভাসিয়ে নিবেদন করা হয় পুষ্পাঞ্জলি। সোমবার মূলবিজু পালিত হয়। মঙ্গলবার গোজ্যেপোজ্যে দিন পালিত হবে যার যার ঘরে।
রোববার সকাল ও সন্ধ্যায় পাহাড়িদের ঘরে ঘরে জ্বালানো হয় মঙ্গল প্রদীপ। বৈশ্বিক মহামারী করোনাসহ যাবতীয় ভয়, অন্তরায়, বাধা-বিপত্তি, দুঃখ-গ্লানির বিনাশ করে নতুন বছরের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে যাতে পৃথিবীর গোটা মানবজাতির অনাবিল সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য প্রার্থনায় করা হয়।
এদিকে করোনার কারণে এবার রাঙ্গামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় কোথাও কোনো উৎসবের উচ্ছ্বাস, আমেজ নেই। সব জায়গায় নীরব-নিস্তব্ধতা। কেবল ঐতিহ্যবাহী সামাজিক রীতিনীতি পালন করতেই রোববার থেকে উদযাপিত হচ্ছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলোর তিন দিনব্যাপী প্রধান সামাজিক উৎসব বিজু।
প্রত্যেক বছর চৈত্র সংক্রান্তিতে বাংলাবর্ষ বিদায় এবং বরণ উপলক্ষে এ উৎসবটি পালন করে পাহাড়িরা। চাকমারীতি অনুযায়ী রোববার পালিত হয়েছে ফুলবিজু। এরপর সোমবার মূলবিজু পালিত হয়। মঙ্গলবার গোজ্যেপোজ্যে দিন পালিত হবে যার যার ঘরে।
উৎসবটিকে চাকমারা বিজু ছাড়াও মারমারা সাংগ্রাই, ত্রিপুরারা বৈসুক নামে পালন করে। এর প্রথম দিন চাকমারা ফুলবিজু, মারমারা পাইংছোয়াই, ত্রিপুরারা হারিবৈসুক, দ্বিতীয় দিন চাকমারা মুলবিজু, মারমারা সাংগ্রাইং আক্যা, ত্রিপুরারা বৈসুকমা এবং তৃতীয় দিন চাকমারা গোজ্যেপোজ্যে দিন, মারমারা সাংগ্রাই আপ্যাইং ও ত্রিপুরারা বিসিকাতাল নামে পালন করে থাকে ঘরে ঘরে।
এটি পাহাড়ি জনগণের প্রাণের উৎসব। প্রত্যেক বছর উৎসবে প্রাণে প্রাণে তৈরি হয় উচ্ছ্বাসের বন্যা। সম্মিলন ঘটে পাহাড়ে বসবাসকারী সব জাতিগোষ্ঠী মানুষের। কিন্তু এবার উৎসবকে কেড়ে নিল প্রাণঘাতী মহামারী করোনাভাইরাস।
দেখা গেছে, করোনার কারণে এবারই প্রথম পাহাড়ে কোনো ‘বিজু’ পালন করতে হচ্ছে, উৎসব ছাড়াই। যুগযুগ ধরে প্রত্যেক বছর বিপুল আনন্দঘন পরিবেশে উৎসবটি পালন করে আসছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। এবার করোনার প্রভাবে উৎসব ছাড়াই যার যার ঘরে কেবল পরিবারের মধ্যেই পালন করতে হবে ‘বিজু’।
করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে শহর থেকে শুরু করে গ্রাম, পাড়া, মহলা পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলার সব জায়গায় যার যার বাড়িঘরে নিরাপদে অবস্থান করছে মানুষ। এ পরিস্থিতিতে কেবল যার যার পরিবারের মধ্যে পাহাড়িরা পালন করছে বিজু-সাংগ্রাই-বৈসুক।
প্রত্যেক বছর উৎসবটিকে ঘিরে রাঙ্গামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং সরকারি বেসরকারি সংস্থা ব্যাপক কর্মসূচির আয়োজন করে থাকে।
এসব বর্ণাঢ্য কর্মসূচির মধ্যে পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, গ্রামীণ পালাগান, র্যা ফেল ড্র লটারি, পাজন ও পিঠা উৎসব, নিজস্ব সংস্কৃতির প্রদর্শনী, নাট্যমঞ্চ, চলচ্চিত্র, সাময়িকী প্রকাশনা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
জানুয়ারি থেকেই এসব কর্মসূচি গ্রহণের প্রস্তুতি শুরু হয়। এবারও পূর্ব থেকে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেও বৈশ্বিক প্রাণঘাতী মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে তা বাতিল করতে হয়েছে বহু সংগঠনকে।
পাহাড়ের অন্যতম সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান রাঙ্গামাটি কালচারাল ইন্সটিটিউশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সচিব চাকমা নবীন বলেন, আমরা বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক উপলক্ষে রাঙ্গামাটিতে বর্ণাঢ্য কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলাম।
তিনি জানান, অনুষ্ঠানসূচীর মধ্যে ১০ এপ্রিল ছিল রাঙ্গামাটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ইন্সটিটিউট প্রাঙ্গণে বিজু-সাংগ্রাই-বৈসুক কনসার্ট। কনসার্টে থাকার কথা ছিল দেশজুড়ে জনপ্রিয় নারী সঙ্গীত ব্যান্ড ‘এফ মাইনর’ ও স্থানীয় জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীরা। এটি ছাড়াও আমাদের ছিল বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ও র্যা ফেল ড্র লটারি। কিন্তু প্রাণঘাতী করোনা মহামারীর কারণে সবকিছু ভেস্তে গেছে।
এসব আয়োজন প্রস্তুতিতে পোস্টারিং, ফেস্টুন, ব্যানার, টিকিট ছাপানো, প্রচার ও প্রকাশনাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থাপনায় প্রায় লক্ষাধিক টাকা ব্যয় হয়েছে বলে তিনি জানান।