করোনার কারণে নীরবেই কেটে গেল সুচিত্রা সেনের জন্মবার্ষিকী
আখতারুজ্জামান আখতার, পাবনা
প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২০, ১১:৫৯ এএম
নীরবেই কেটে গেল সুচিত্রা সেনের জন্মবার্ষিকী
করোনাভাইরাসের কারণে নীরবেই কেটে গেল পাবনার মেয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের জন্মবার্ষিকী। প্রতি বছর নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করা হয় মহানায়িকার জন্মবার্ষিকী।
এ ছাড়া চলচ্চিত্র উৎসবেরও আয়োজন করা হয়। এবারেও ৬ এপ্রিল সপ্তাহব্যাপী চলচ্চিত্র উৎসব করার পরিকল্পনা ছিল পাবনার সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে তা আর হয়নি।
এ দিকে মহানায়িকার পাবনাস্থ পৈত্রিক বাড়িটি স্থায়ী সংগ্রহশালা বা আর্কাইভের দাবি জানিয়েছেন পাবনাবাসীসহ সুচিত্রা ভক্তরা। বাড়িটি কয়েক বছর আগে দখলমুক্ত হয়ে সরকারি হেফাজতে নেয়া হলেও এখনও সে দাবি পূরণ হয়নি।
পাবনার মেয়ে সুচিত্রা সেন ওরফে রমা ওরফে কৃষ্ণা। যার অনবদ্য অভিনয় এবং অপরূপ সৌন্দর্য আজও দাগ কেটে আছে কোটি দর্শকের হৃদয়ে। অভিনয় গুণে যিনি হয়ে উঠেছিলেন দুই বাংলার চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষের কাছে মহানায়িকা।
এ মহানায়িকার জন্মস্থান পাবনা শহরের হেমসাগর লেনের পৈত্রিক বাড়িটি দর্শনার্থী ভক্ত অনুরাগীদের পাদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে। সুচিত্রা সেন পাবনা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে (বর্তমানে সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়) নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন ভারতে চলে যান এবং বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
তিনি তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন সে সময়ের মহাকালী পাঠশালায়, যেটি বর্তমানে পাবনা টাউন গার্লস হাইস্কুল। তার বাবা পাবনা পৌরসভায় সেনেটারি ইনস্পেক্টর পদ থেকে অবসর নেন এবং '৫০-এর দশকে সপরিবারে ভারতে চলে যান।
এরপর থেকে সুচিত্রা সেনের পৈত্রিক বাড়িটি প্রথমে শক্র সম্পত্তি এবং পরে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে জেলা প্রশাসনের অধীনে থাকে। ১৯৮৭ সালের দিকে বাড়িটি একটি রাজনৈতিক দল পরিচালিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে লিজ দেয়া হলে সেটি তারা দখলে রাখেন।
বাড়িটি মুক্ত করে এটি মহানায়িকার সংগ্রহশালা বা স্মৃতি কেন্দ্র করার দাবিতে সাংবাদিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ আন্দোলনে নামেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের জুলাই মাসে বাড়িটি দখলমুক্ত হলে সেটি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় তাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে জেলা প্রশাসনের হেফাজতে দেয়। এখনও শত শত নারী-পুরুষ প্রতিদিন বাড়িটি দেখতে আসেন।
সম্প্রতি বাড়িটিতে দর্শনার্থীদের দেখার জন্য ভিডিও প্রজেকশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাড়ির চত্বরে নির্মাণ করা হয়েছে সুচিত্রা সেনের ভাস্কর্য। সুচিত্রা সেনের পৈত্রিক বাড়ি সংস্কার করে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ছোট পরিসরে স্মৃতি সংগ্রহশালা করা হয়েছে।
সরকারের উদ্যোগে সুচিত্রা সেন স্মৃতি আর্কাইভ বা সংগ্রহশালাসহ বাড়িটি আধুনিকায়নের দাবি জানিয়েছেন পাবনার সাংস্কৃতিক কর্মীরা।
সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নরেশ মধু বলেন, এবারে মহানায়িকার জন্মদিবস সামনে রেখে চলচ্চিত্র উৎসবের পরিকল্পনা ছিল। ভারত থেকেও তার স্বজন বা ভক্ত অনুরাগীর আসার কথা ছিল উৎসবে। কিন্তু করোনার কারণে তার জন্মদিনের সব কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে।
১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল সুচিত্রা সেন জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতার বালিগঞ্জে স্বেচ্ছা নির্বাসনে প্রায় তিন যুগ লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলেন কিংবদন্তি এই অভিনেত্রী। অনেকদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি ৮২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন।
পাবনার উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে রমা বনেদি পরিবারের বধূ হয়ে ঘর-সংসারের পাশাপাশি চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। বিয়ের আড়াই বছরের মাথায় ১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায়’ নামের একটি বাংলা ছবিতে তিনি প্রথম অভিনয় করেন সুচিত্রা। কিন্তু এটি মুক্তি পায়নি।
১৯৫৩ সালে নায়িকা হিসেবে তার প্রথম ছবি ‘সাত নম্বর কয়েদি’ মুক্তি পায়। এর পরিচালক ছিলেন সুকুমার দাশগুপ্ত। তারই সহকারী পরিচালক নীতিশ রায় রমা নাম বদলে রাখেন ‘সুচিত্রা সেন’।
১৯৫৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত টানা অভিনয় করেন সুচিত্রা সেন। স্বামীর প্রবল আপত্তি থাকলেও মনের তাগিদে নিজেকে অভিনয়ে জড়িয়ে রাখেন তিনি। ৫৬টি বাংলা ও হিন্দি ৭টি মিলিয়ে ৬৩টি ছবিতে নায়িকা হন এই স্বপ্নসুন্দরী।
উত্তম কুমারের সঙ্গে জুটি হয়ে ব্যাপক আলোড়ন তোলেন তিনি। ১৯৬৩ সালে ‘সাত পাকে বাঁধা’ চলচ্চিত্রের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেত্রী পুরস্কার জেতেন সুচিত্রা সেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি কোনো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন।
ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে। ২০০৫ সালে তাকে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার দেয়ার প্রস্তাব রাখলে তিনি জনসমক্ষে আসতে চাননি বলে তা গ্রহণ করেননি।
এ দিকে পাবনার জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ জানান, সুচিত্রা সেনের বাড়িটি আধুনিকায়নসহ সরকারি উদ্যোগে প্রাতিষ্ঠানিক সংগ্রহশালাসহ সাংস্কৃতিক লালনকেন্দ্রে রূপ দেয়ার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি এতে সবার সহযোগিতা কামনা করেন।
তিনি বলেন, আমরা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। এই দুর্যোগ কেটে গেলে সব ব্যবস্থাই করা হবে।