Logo
Logo
×

সারাদেশ

সিএনজিচালিত অটোরিকশা

৯০০ টাকার জমা বেড়ে ১৮০০ টাকা! ভাড়া কয়েকগুণ

Icon

ডেমরা (ঢাকা) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১১:০০ পিএম

৯০০ টাকার জমা বেড়ে ১৮০০ টাকা! ভাড়া কয়েকগুণ

মিটারে সিএনজিচালিত অটোরিকশা না চালানোর এক দফা দাবির আন্দোলন সফলের পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি ও আইনি ব্যবস্থা না থাকায় আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে রাজধানীর সিএনজিচালক ও মালিকরা। 

মিটারে না চললে ৫০ হাজার টাকা জরিমানার আইনের বাস্তবায়ন প্রত্যাহারের সুযোগে ৯০০ টাকার জমা এখন ১৮০০ টাকা নির্ধারণ করেছেন মালিকরা। এই বাড়তি টাকা উঠাতে গিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে কয়েকগুণ ভাড়া আদায় করছেন চালকরা। 

এছাড়া নারী যাত্রীদের পরিস্থিতি বিবেচনা করে সুযোগ বুঝে সিরিয়ালের অজুহাতে জিম্মিদশায় রেখে তাদের কাছ থেকে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া আদায় করে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে হঠাৎ করে ২০২২ সালের আইন ২০২৫ সালে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ জনগণ, সিএনজির মালিক ও চালকদের সামনে তুলে ধরেছে। এ সুযোগে সংশ্লিষ্টদের এক দফা আন্দোলনের সুযোগ করে দিয়েছিল বলে বিআরটিএর বিরুদ্ধে অভিযোগ যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও সাধারণ মানুষের।

এদিকে মিটারে না চালালে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আইনটি ২০১৮ সালের সড়ক ও পরিবহণ আইনের বিধিমালা জারি হয় ২০২২ সালে। হঠাৎ করে ২০২৫ সালে বিআরটিএ ওই আইনটি প্রকাশ্যে সবার সামনে এনে চালক-মালিকদের এক আন্দোলনের সুযোগ করে দিয়েছে। অথচ সড়ক আইন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ যদি কৌশলে অপ্রকাশ্যে ধারা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে ওই আইন বাস্তবায়ন করতো তাহলে আন্দোলনেরই সুযোগ পেত না কেউ।

যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, অসাধু একটি সিন্ডিকেটের নির্দেশে ঢাকার বৈধ ১৫ হাজার ও অবৈধ ৫ হাজার মিলে ২০ হাজার সিএনজি অটোরিকশা খাতকে আলোচনায় রেখে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করেছে। 

এদিকে আইন জারির পরপরই কতিপয় সিন্ডিকেটধারী সিএনজি অটোরিকশা মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা চালকদের উস্কে দিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা বন্ধ রেখে নগরজুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছিল। 

বিগত দিনে ওই পরিস্থিতিতে বিআরটিএ এই সিন্ডিকেটের কাছে নতি স্বীকার করে অসহায় যাত্রীদের ওই চালকদের হাতে তুলে দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।  

সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ সব এলাকাগুলোতে শুরু থেকেই সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলো মিটারভিত্তিক ভাড়ায় যাত্রী পরিবহণ করে না। ফলে যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ইতোপূর্বে বিআরটিএর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসায় চালকরা আরও বেশি ভাড়া আদায়ে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এতে জিম্মি দশায় পড়ে সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তি বেড়েছে কয়েকগুণ। 

বেপরোয়া চালকদের এমন চিত্র দেখা গেছে- রাজধানীর ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, গুলশান, হাতিরঝিল, রামপুরা, বাড্ডা, হাজারিবাগ, মিরপুর, কুড়িল, বিমানবন্দর এলাকা, উত্তরা, ধানমন্ডিসহ ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের ১২৯ ওয়ার্ড এলাকায়। 

সিএনজিচালিত অটোরিকশা স্ট্যান্ডগুলোতে চালকরা যাত্রীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে, যার ফলে প্রতিদিনই সাধারণ যাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। কেউ আপত্তি করলে চালকরা তর্কে জড়িয়ে পড়ছে, এমনকি অনেক সময় যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করছে। এছাড়া নারী যাত্রীদের কাছ থেকে সুযোগ বুঝে সিরিয়ালের অজুহাতে জিম্মি দশায় রেখে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া আদায় করে।

যাত্রীদের অভিযোগ, পরিবার নিয়ে ভ্রমণ, জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া কিংবা যাত্রীদের চাপ বেশি থাকলে চালকদের আচরণ অসহযোগিতাপূর্ণ হয়ে ওঠে, এক্ষেত্রে ২০০ টাকার ভাড়া ৫০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। 

এছাড়া আবাসিক এলাকায় ভালো মানের হাসপাতাল না থাকায় অসুস্থ রোগীদের হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হলে চালকরা ইচ্ছেমতো ভাড়া হাঁকায়, যা রোগীর পরিবারের জন্য আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে। এমনকি বিদেশগামী যাত্রীরাও এই অনিয়মের শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে রাতের ফ্লাইট থাকলে বিকল্প বাহণের অভাবে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া গুনতে বাধ্য হন যাত্রীরা। 

এ বিষয়ে যাত্রীরা প্রশাসনের কাছে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন, যাতে মিটারভিত্তিক ভাড়ার নিয়ম নিশ্চিত করে যাত্রী হয়রানি বন্ধ করা হয়।

খিলগাঁও থানাধীন নাসিরাবাদের বাসিন্দা ভুক্তভোগী শাকিল আহমেদ বলেন, সকালে ব্যবসায়িক কাজে যাওয়ার সময় আমি মিটারে যেতে বললে চালক সোজা বলে দিল- ভাই, মিটারের কথা বলবেন না, যেতে হলে চুক্তিতে যান, নইলে অন্য গাড়ি দেখেন। ব্যস্ততম এলাকায় যানজটের কারণে তো বিকল্প কিছু নেই, বাধ্য হয়েই বেশি টাকা দিয়ে যেতে হয়। আবার অনেক সময় পথের মাঝে জ্যাম বেশি থাকলে চালক অতিরিক্ত টাকা দাবি করে বসেন।  দিতে আপত্তি জানালে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে অকপটে বলেন- নামেন, আর যেতে পারব না।

ডেমরা থেকে যাত্রাবাড়ীগামী যাত্রী সালমা আক্তার বলেন, অল্প দূরত্বে চালকরা যেতে চায় না। যেতে চাইলেও বলে বেশি ভাড়া লাগবে। অনেক সময় দরদাম করেও যাওয়া সম্ভব হয় না। মিটারের হিসাবে স্টাফ কোয়ার্টার থেকে যাত্রাবাড়ী ভাড়া হওয়ার কথা ১০০ টাকা, কিন্তু আমার কাছে ৩৫০ টাকা দাবি করেছে। আমি মিটারে যেতে বললে আমাকে নিতে রাজি হয়নি।

আগে চালকরা শর্ত দিতেন, ট্রাফিক পুলিশ আটকালে মিটারে গন্তব্যে যাওয়ার কথা স্বীকার করতে হবে। সে সময় চালকদের মধ্যে পুলিশের কিছুটা ভীতি কাজ করত। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। এখন ট্রাফিক পুলিশ দেখলেও চালকরা নির্ভীক থাকছেন, কারণ তারা নিশ্চিত যে শাস্তির সম্ভাবনা নেই। ফলে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। 

এছাড়া একটু বৃষ্টি হলে বা রাতের বেলায় তাদের কারণে যাত্রীরা আরও অসহায় হয়ে পড়ছেন। এতে সাধারণ যাত্রীরা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এই অনিয়ম ক্রমশ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।

সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকদের দাবি, বর্তমানে ৯০০ টাকার জমা ১৮০০ টাকা। এক্ষেত্রে চলার কোনো নির্ধারিত সময় নেই, ২৪ ঘণ্টাই চালানো যায়। মিটারভিত্তিক ভাড়া অনুযায়ী চললে তাদের দৈনিক জমা এবং জ্বালানির খরচ উঠানো কঠিন হয়ে যায়। 

এছাড়া রাস্তায় যানজট ও যাত্রাবিরতির কারণে মিটারে চললে তাদের লোকসান গুনতে হয়। পাম্পে গ্যাস নেওয়ার সময় দীর্ঘ লাইনে সময় নষ্ট হয় অনেক বেশি।

 বাড্ডা এলাকার সিএনজিচালক রুহুল আমিন জানান, আধাবেলা চালালে প্রতিদিন মালিকের ১২০০ টাকা জমা, গ্যারেজ ভাড়া, গ্যাস ও অন্যান্য খরচসহ ১৫০০-১৬০০ টাকা লাগে। এর সঙ্গে খাবারের খরচ তো আছেই। পাশাপশি যানজট, যাত্রীর জন্য অপেক্ষা, খাবার ও বিরতির কারণে ৬-৭ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালানো যায় না। ঘণ্টায় গড়ে ২৩০ টাকা খরচ হলেও মিটারের হিসাবে জমার টাকাই উঠে না, বেতন তো দূরের কথা।

সিএনজিচালক ফরিদ জানান, ২০১২ সালের নিয়মানুযায়ী মিটারে প্রথম ২ কিলোমিটার ৪০ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ১২ টাকা এবং যানজটে প্রতি মিনিটে ২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তখন মালিকের জমা এবং গ্যাসের দাম অনেক কম ছিল। 

বর্তমানে গ্যাসের দাম ও মালিকের জমা উভয়ই বেড়েছে, ফলে খরচও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। এছাড়া রাস্তার যানজট ও অন্যান্য ব্যয় বিবেচনায় নিয়ে মিটারের ভাড়ায় চলা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাই তাদের বাধ্য হয়ে চুক্তিভিত্তিক ভাড়া নিতে হয়।

ডেমরা এলাকার সিএনজি অটোরিকশা মালিক মো. রাব্বি জানান, বর্তমানে একটি সিএনজি অটোরিকশা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে গেছে। যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে যন্ত্রাংশ, টায়ার, ব্যাটারি এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের খরচও। এতে মালিকদের ওপর বাড়তি আর্থিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, যা সামাল দেওয়া দিনকে দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। 

সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করলে গাড়ির কর্মক্ষমতা কমে যায়। অথচ অতিরিক্ত খরচ জোগানো কঠিন হয়ে পড়ছে। এছাড়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ করার বিষয়ও রয়েছে। ফলে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমা না রাখলে তারা ক্ষতির মুখে পড়েন।

সিএনজি মালিক মো. জুলহাস মিয়া জানান, নতুন নিবন্ধন না দেওয়ায় পুরোনো নিবন্ধন নম্বরের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। ফলে বর্তমানে একটি সিএনজি কিনতে ২৭-৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়, যেখানে একই মূল্যে দুটি মাইক্রোবাস কেনা সম্ভব। 

তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবসায় থাকার কারণে অন্য কোনো বিকল্প ভাবা সম্ভব নয়। তাছাড়া ঋণ পরিশোধ, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ এবং কর্মচারিদের বেতন দিতে হয়। 

তার মতে, সরকার যদি নতুন ভাড়ার হার নির্ধারণ করত, তাহলে চালকরাও সমস্যায় পড়ত না এবং মালিকরাও সঠিকভাবে গাড়ি পরিচালনা করতে পারতেন।

ট্রাফিক ওয়ারি বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার আজাদ রহমান মোবাইল ফোনে বলেন, বিআরটিএর বর্তমান নির্দেশনা অনুযায়ী মিটারে ভাড়ার বিষয়টি নিয়ে ট্রাফিক পুলিশের কিছু বলার নেই। তবে সড়কে বেপরোয়া বা অন্যান্য ট্রাফিক আইন অমান্য করলে অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিনই আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে মামলা ও রেকারিং করা হচ্ছে।  

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী মোবাইল ফোনে বলেন, এ বিষয়টি সমাধানের জন্য আমরা বলতে বলতে ক্লান্ত। বেপরোয়া চালকদের নিয়ন্ত্রণে এবং যাত্রীদের পাশে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসছে না। বিআরটিএর চেয়ারম্যান হঠাৎ আইন সামনে এনে আন্দোলনের সুযোগ করে দিয়েছে। এখন সরকারের কাছে প্রশ্ন বেপরোয়া চালক ও মালিকদের থামাবে কে?

সিএনজি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম