
প্রিন্ট: ১২ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৪৪ এএম
পল্লীকবির বাড়ি ও স্মৃতিচিহ্ন নষ্ট হচ্ছে অযত্ন-অবহেলায়

আরও পড়ুন
‘তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়’, ‘এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে’-এমন অসংখ্য কবিতার রূপকার পল্লীকবি জসীমউদ্দীন। কবি শায়িত আছেন তার বিখ্যাত ‘কবর’ কবিতার ফরিদপুর শহরের অম্বিকাপুর গ্রামের সেই ডালিম গাছের নিচে। বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বব্যাপী যিনি তুলে ধরেছিলেন, সেই কবির বাড়ির আঙিনাটি পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়। দেশ-বিদেশে কবিভক্তরা অম্বিকাপুরের বাড়ির আঙিনায় এসে নিরাশ হচ্ছেন। কবির বাড়িসংলগ্ন একটি জাদুঘর করা হলেও সেখানে কবির স্মৃতিবিজড়িত তেমন কিছুই নেই। প্রচারের অভাবে তেমন কেউ যাচ্ছেন না সেখানে। প্রতিবছর কবির বাড়ির আঙিনায় মাসব্যাপী মেলা হলেও করোনার সময়ে তা বন্ধ ছিল। এ বছর মেলা হয়নি। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে আসা কবিভক্তরা নিরাশ হয়ে ফিরে গেছেন। তাই কবির বাড়িটিকে ঘিরে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে-এমনটাই প্রত্যাশা কবিভক্ত-অনুরাগীদের।
কবির বাড়িতে আসা দর্শনার্থীরা জানান, পল্লীকবির জন্মদিন উপলক্ষ্যে প্রতিবছর পহেলা জানুয়ারি জেলা প্রশাসন ও জসীম ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে কবির কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ, মিলাদ ও আলোচনা সভা হয়ে আসছিল। গত কয়েক বছর রাজনৈতিক অস্থিরতায় জসীম ফাউন্ডেশনের কমিটি নেই। এতদিন কবিপুত্র ড. জামাল আনোয়ারের উদ্যোগে কবির বাড়ি কিছুটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং রক্ষণাবেক্ষণ করে ঠিকঠাক রাখা হলেও বর্তমানে বেহালে। গত ২৫ ডিসেম্বর কবিপুত্র ড. জামাল আনোয়ার মারা যাওয়ার পর কবির বাড়ি ও তার স্মৃতিচিহ্ন রক্ষণাবেক্ষণে তেমন খেয়াল রাখা হচ্ছে না। কবির বাড়িতে ঢুকতে প্রবেশমূল্য ২০ টাকা দিতে হয়। তবে বাড়ির ভেতরে ঢুকলে হতাশ হতে হয়। কবির স্মৃতিচিহ্ন রাখা ঘরগুলোতে মাকড়সা বাসা বেঁধেছে। ধুলোবালিতে ঢেকে রয়েছে কবির অমূল্য স্মৃতিচিহ্নগুলো। শুধু ঈদ কিংবা পূজায় কিছুটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলেও এবার অবস্থা ভিন্ন। অপরিচ্ছন্ন, ধুলাবালি আর ময়লা-আবর্জনা যেখানে-সেখানে।
ফরিদপুর শহর থেকে আড়াই কিলোমিটার উত্তরে অম্বিকাপুর গ্রাম। কুমার নদের পাশে গ্রামীণ পরিবেশে গড়ে উঠেছে জসীম উদ্যান। এখানে প্রতিবছর মেলার আয়োজন করা হলেও এ বছর মেলা হয়নি। ফলে জসীম উদ্যানের মাঠে শুকানো হচ্ছে পেঁয়াজসহ নানারকমের শস্য। জসীম উদ্যানের দুটি দৃষ্টিনন্দন ঘাটলা সরকারি খরচে করা হলেও দেখভালের অভাবে দুপাশের স্টিলের রেলিংগুলো চুরি হয়ে যাচ্ছে। অবৈধভাবে দোকানপাট ও চটপটির দোকান গড়ে উঠেছে। প্রভাবশালীরা জসীম উদ্যান দখলের পাঁয়তারা করছে।
স্থানীয় অধিবাসী ও কবি পরিবারের স্বজন হারুন অর রশিদ বলেন, কবির বাড়িটি নিয়ে বিভিন্ন সময় সরকারের তরফ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাস্তবে তেমন কিছু হয়নি। পরিকল্পনামাফিক কাজ করার মাধ্যমে বাড়িটিকে দর্শনীয় স্থান বানানো গেলে কবিভক্তরা এখানে এসে পরিতৃপ্ত হবেন।
সাহিত্যিক ও সাংবাদিক মফিজ ইমাম মিলন বলেন, কবির ব্যবহার্য দুর্লভ ছবি, লেখনী ও স্মৃতিচিহ্ন টিকিয়ে রাখতে স্থানীয়দের সহযোগিতায় ও প্রশাসনের সহায়তায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। কবির বাড়িতে শুধু দেশের দর্শনার্থীরাই নয়, কলকাতার কবি সাহিত্যিকরা কবির স্মৃতিচিহ্ন দেখতে এসেছেন। সেই জিনিসগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এটা দুঃখজনক।
ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুস সামাদ বলেন, পল্লীকবিকে নিয়ে আমাদের অনেক কিছুই করার ছিল কিন্তু আমরা তেমন কিছুই করতে পারিনি। এটা ফরিদপুরবাসী হিসেবে সবার ব্যর্থতা।
কবিপুত্র প্রয়াত ড. জামাল আনোয়ারের স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা যুগান্তরকে বলেন, এতদিন আমার স্বামী বাড়ি ও কবির স্মৃতিচিহ্ন রক্ষণাবেক্ষণ করত। এখন আমার দুই সন্তান নিয়ে চলাই কষ্ট। কোনোদিক থেকে তেমন টাকা-পয়সা পাইনি। আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর সম্পত্তি নিয়ে অশান্তিতে আছি। আমি মহিলা মানুষ। এ বাড়ি ও কবির স্মৃতিচিহ্ন দেখে রাখা আমার জন্য কষ্টকর। যদি জসীম ফাউন্ডেশনের সভাপতি জেলা প্রশাসক ও সরকার দায়িত্ব নিয়ে দেশের সম্পদ কবির বাড়ি, কবর ও তার অমূল্য স্মৃতিচিহ্ন রক্ষার ব্যবস্থা করত তাহলে ভালো হতো। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান মোল্যা বলেন, বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে কবির জন্মবার্ষিকী পালন করা হয়। তবে এ বছর মেলা করা সম্ভব হয়নি। আগামী বছর আশা করছি মেলা করা যাবে। কবির স্মৃতিচিহ্ন টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করা হবে।
পল্লীকবির জন্ম ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর শহরতলির তাম্বুলখানা গ্রামের নানাবাড়িতে। ১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ তিনি মারা যান। কবির সন্তানদের মধ্যে বর্তমানে জীবিত আছেন পুত্র খুরশিদ আনোয়ার, বাবু আনোয়ার, মেয়ে হাসনা মওদুদ ও আসমা তৌফিক।