
প্রিন্ট: ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ০২:৪০ এএম

শহীদুল্লাহ শাহরিয়ার, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
চট্টগ্রামের ১৬টি সংসদীয় আসনের মধ্যে চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি) আসনটি ভিআইপি হিসাবে পরিচিত। কারণ, এ আসন থেকে যে দলের প্রার্থী ভোটে জয়ী হন, সেই দলই সরকার গঠন করে। আবার সেই সংসদ-সদস্য সরকারের মন্ত্রিসভায়ও স্থান পান। ১৯৯১ সাল থেকে অনুষ্ঠিত প্রায় সবকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ চিত্রই স্পষ্ট হয়েছে। তাই এ আসনে দলগুলো মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থান পর্যালোচনা করে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হাওয়া ইতোমধ্যে বইতে শুরু করেছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে অথবা আগামী বছরের জুনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে-স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা এ ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। যদিও দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট তারিখ ও রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছে। সংস্কারের নামে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন বিলম্বিত করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ করছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘এ সরকার ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে শেখ হাসিনার সুরে কথা বলছে। উন্নয়নের গল্প শুনিয়ে ভোটাধিকার হরণ করার চেষ্টা করছে।’ এরপরও নির্বাচনি প্রস্তুতি থেমে নেই। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন ঘিরে তৎপরতা শুরু করেছে। এবারের ঈদ উৎসবকে তারা কাজে লাগিয়েছেন নির্বাচনি প্রচারণায়।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি) আসন থেকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মেয়র মীর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শামসুল আলম এবং চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর এবার মনোনয়ন চাইছেন। বিগত একটি নির্বাচনে এই আসন থেকে নগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন নির্বাচন করলেও আদালতের রায়ে তাকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করা হয়েছে। যথারীতি তিনি মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এ কারণে সংসদ-সদস্য প্রার্থী হতে মনোনয়ন চাইবেন কি না, এটি এখনো স্পষ্ট নয়। নগরীর চারটি সংসদীয় এলাকার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এক সিটি করপোরেশনেই। তাছাড়া মেয়র পদটি প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদারও। যদিও ডা. শাহাদাতকে এখনো সেই মর্যাদা দেওয়া হয়নি। বিগত মেয়র আওয়ামী লীগের রেজাউল করিম চৌধুরী প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করেছেন। জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। কোতোয়ালি আসন থেকে এবার জামায়াতের দাঁড়িপাল্লার প্রার্থী হচ্ছেন ডা. ফজলুল হক। তিনি চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের সাংগঠনিক সম্পাদক।
আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না, এ বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। তাই এ আসনে দল দুটির প্রার্থী কে হবেন, সেই আলোচনাও শুরু হয়নি। বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (মোমবাতি) এ আসন থেকে দলের চেয়ারম্যান এমএ মতিনকে প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা দিতে পারে। বিগত প্রায় সবকটি জাতীয় নির্বাচনে দলটি এ আসন থেকে প্রার্থী দিয়েছিল। নবগঠিত এনসিপি বা জাতীয় নাগরিক পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, সিপিবি বা অন্য দলগুলোর প্রার্থী কে হবেন-সে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসেনি। তবে যত দলই অংশগ্রহণ করুক না কেন, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি যদি এই নির্বাচনে অংশ না নেয়, সেক্ষেত্রে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। যদিও এ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভোটের ব্যবধান থাকবে বিশাল। বিগত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভোটারবিহীন হওয়ায় এ আসনে ভোটের হিসাব নতুন করে কষতে হবে। এ আসনের আরও একটি বিশেষত্ব হচ্ছে এখান থেকে কোনো দলের প্রার্থী টানা দুবার নির্বাচিত হতে পারেননি। অবশ্য ভোটারবিহীন নির্বাচনে প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ২০১৮ ও ২০২৪ সালে এই আসন থেকে সংসদ-সদস্য হন।
১৯৯১ সাল থেকে বিগত ৭টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ব্যতীত) এই আসনের নির্বাচনি ফলাফল এবং সরকার গঠনের চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৯১ সালে আসনটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থী আবদুল্লাহ আল নোমান। ওই সময় সরকার গঠন করে বিএনপি। আবদুল্লাহ আল নোমান ওই সরকারের মৎস্য ও পশুসম্পদমন্ত্রী হন। ১৯৯৬ সালে আবদুল্লাহ আল নোমানকে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএ মান্নান। ওই মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং এমএ মান্নান সরকারের শ্রমমন্ত্রী হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে আবার এমএ মান্নানকে হারিয়ে আসনটি পুনরুদ্ধার করেন বিএনপির নোমান। বর্তমানে এ দুই নেতা প্রয়াত। ২০০৮ সালে এই আসনে নৌকার মনোনয়ন দেওয়া হয় বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী, বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম বিএসসিকে। বিপরীতে ধানের শীষের মনোনয়ন পান বিএনপির শামসুল আলম। খাতুনগঞ্জের বনেদি ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান শিল্পপতি শামসুল আলমকে হারিয়ে নুরুল ইসলাম বিএসসি এ আসনে জয়লাভ করেন। আওয়ামী লীগ আবারও সরকার গঠন করে। ভিআইপি এই আসন থেকে ভিআইপি প্রার্থী হিসাবে জয়লাভ করার পর সরকারের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় নুরুল ইসলাম বিএসসিকে। এরপর আরও তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলেও এসব নির্বাচন ছিল বিতর্কিত। দিনের ভোট রাতে নিয়ে, ভোটারবিহীন এবং ‘আমি আর ডামি’ প্রার্থীর তিনটি নির্বাচনে দেখা গেছে, কোতোয়ালি আসন থেকে ২০১৪ সালে জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু সংসদ-সদস্য হন। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয় প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে। তার বিপরীতে বিএনপির ডা. শাহাদাত হোসেন এই আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু তাকে হারিয়ে দেওয়া হয় কেন্দ্র দখল করে। ২০২৪ সালেও নওফেল মনোনয়ন পান আওয়ামী লীগের। এই মেয়াদে ‘আমি আর ডামি’ প্রার্থীর নির্বাচনে নওফেল ছিলেন ‘জয়ী।’ এ দুই মেয়াদের প্রথম মেয়াদে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী, দ্বিতীয় মেয়াদে শিক্ষামন্ত্রীর পদ লাভ করেন নওফেল। কোতোয়ালি আসনে নির্বাচনে প্রার্থীর জয়ের বড় নিয়ামক হচ্ছে বাকলিয়ার ভোট। এ এলাকার ভোট যে প্রার্থীর বাক্সে যায়, সেই প্রার্থীই জয়লাভ করেন। এ আসনে ভোটের লড়াইয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, জাতীয় পার্টি (জেপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ অতীতে বিভিন্ন নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে। আগামী দিনে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হলে এসব দলও প্রার্থী দিতে পারে।
কোতোয়ালি আসন থেকে এবার মনোনয়ন চাইবেন বিএনপির হেভিওয়েট নেতা, চট্টগ্রাম সিটির সাবেক মেয়র ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মীর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন। ২০০১ সালে এই আসন থেকে তাকে বিএনপি মনোনয়ন দিলেও পরবর্তী সময়ে কৌশলগত কারণে তা প্রত্যাহার করে আবদুল্লাহ আল নোমানকে দেওয়া হয়। বিএনপি ক্ষমতায় এলে মীর নাসিরকে টেকনোক্র্যাট কোটায় বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী করা হয়। আবদুল্লাহ আল নোমান প্রয়াত হওয়ায় এই আসনে হেভিওয়েট নেতা হিসাবে মীর নাসিরই রয়েছেন। মীর নাসির যুগান্তরকে বলেন, সিটি মেয়র ও মন্ত্রী থাকাকালে শুধু কোতোয়ালি নয়, পুরো চট্টগ্রামের উন্নয়নে কাজ করেছি। শত শত লোকের চাকরির ব্যবস্থা করেছি। আমি এই আসনে মনোনয়ন চাইব। দল যদি মনোনয়ন দেয়, তাহলে নির্বাচন করার জন্য প্রস্তুত আছি।
এ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শামসুল আলম। একজন সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি থেকে তিনি রাজনীতির মাঠে এসেছিলেন ২০০৮ সালে। বিএনপি থেকে পেয়েছিলেন মনোনয়নও। কিন্তু রাজনীতিতে নবাগত এই নেতা আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা ও শিল্পপতি নুরুল ইসলাম বিএসসির কাছে ধরাশয়ী হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তার ব্যবসার ওপরও আসে নানা ঝড়ঝাপটা। সরকারের অসহযোগিতা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কারণে তার ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামে। দেশের অন্যতম শীর্ষ ঋণখেলাপিতে পরিণত হয় তার ব্যবসায়িক কোম্পানি ইলিয়াছ ব্রাদার্স বা এমইবি গ্রুপ। এ অবস্থায় শুরুর দিকে কিছুদিন সরব থাকলেও মাঝে ৮-১০ বছর রাজনীতির মাঠে নীরব হয়ে যান। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আবারও দলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হয়েছেন। শামসুল আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া এবং ধানের শীষে নির্বাচন করাটা যেন আমার অপরাধ ছিল। এ কারণে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আমার ব্যবসা-বাণিজ্যের ভয়াবহ ক্ষতি করেছে। আমাকে জেলও খাটতে হয়েছে। এরপরও আমি দল ছেড়ে যাইনি। আমার সেই ত্যাগের মূল্যায়ন আশা করি দল করবে। বাকলিয়ার বাসিন্দা হওয়ার কারণে ভোটে আমার একটি বাড়তি সুবিধা থাকবে। কারণ, কোতোয়ালি আসনে সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণ হয় বাকলিয়ার ভোটে।’
কোতোয়ালি আসনে আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর যুগান্তরকে জানান, ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে তিনি বিগত ১৬ বছরে সাতবার জেলে গেছেন। জেলের অভ্যন্তরে থাকা ছাড়া বাকি একদিনের জন্যও রাজনীতির মাঠ থেকে বাইরে ছিলেন না। দলের নেতাকর্মীদের আগলে রাখা, সুখে-দুঃখে পাশে থাকা, রাজনীতির মাঠে সক্রিয় রাখার কাজটি তিনি করেছেন। প্রতিনিয়ত রাজপথে পুলিশের জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তিনি বলেন, আশা করছি দল আমার এই ত্যাগের মূল্যায়ন করবে। মনোনয়ন পেলে আমি দলমতনির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের ভোটে জয়ী হয়ে আসতে পারব-এটা আমার দৃঢ়বিশ্বাস।
এই আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ডা. ফজলুল হক। দলের নির্বাচনি বোর্ড ইতোমধ্যে তার নাম চূড়ান্ত করেছে। বিদেশে অবস্থান করায় তার বক্তব্য নেওয়া যায়নি। তবে জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগর শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি মাহমুদ উল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, অত্যন্ত যোগ্য হিসাবেই ডা. ফজলুল হককে দল মনোনয়ন দিয়েছে। যেহেতু কোতোয়ালি আসনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ভিআইপি আসন; ডা. ফজলুল হকও দলের এই সিদ্ধান্ত সাদরে গ্রহণ করেছেন। তিনি আরও বলেন, ডা. ফজলুল হক দল ছড়াও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালের এমডি, পার্কভিউ হাসপাতালের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের ভাইস চেয়ারম্যান, ইসলামিক ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যসহ বহু সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। কোতোয়ালি আসনে তার মতো যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচন করলে ভোটাররা তাকে বঞ্চিত করবেন না-এটা জামায়াতে ইসলামীর বিশ্বাস।