
প্রিন্ট: ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:১১ এএম
রাঙ্গাবালীর বুড়াগৌরাঙ্গ নদী তীরের মান্তাদের ঈদ

রাঙ্গাবালী (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৫, ০৭:৫৮ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
আরও পড়ুন
নদীর কিনারে সারি সারি নৌকা, তারই একটির গলুইতে বসে আছেন ঝুমুর বেগম। ছোট্ট শিশু মুন্নি নৌকার বৈঠায় হাত রেখে আনমনা চোখে তাকিয়ে আছে। চোখের সামনে শান্ত নদী। বুকের ভেতর তোলপাড় করে কষ্ট। ঝলমলে আকাশে খা খা রৌদ্দুর। বাজারে ঈদের আমেজ। কিন্তু তাদের ভাসমান জীবনে সেই আমেজের ছিটেফোঁটাও নেই।
‘গাঙে মাছ নাই, হাতে টাহা (টাকা) নাই। গরীব গো আবার কিয়ের ঈদ।’ এমন কথাই আক্ষেপের মত বেড়িয়ে এল ঝুমুর বেগমের মুখ থেকে। তার স্বামী শহীদ হাওলাদার চুপচাপ নৌকার ছইয়ে শুয়ে আছেন। নদীতে মাছ ধরে সংসার চলত, এখন নদী যেন অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। নদীতে তেমন মাছ নেই, যাও পাওয়া যায় তা দিয়ে কোনো মতে সংসার চলানো দায়।
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়ন ঘেঁষা বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর তীরে মান্তা পল্লীতে বাস করেন ঝুমুর-শহীদ দম্পত্তি। ঝুমুর বেগমের পাশের নৌকাটি সোহেল ভূঁইয়ার। তার নৌকায় তাকাতেই আরেক দৃশ্য। ছোট্ট মেয়ে জমেলা নৌকার সামনেই বসা। তীরের শিশুদের দিকে তাকিয়ে আছে। আরেক বোন মিমিলা নৌকার পেছনের দিকে বসা।
নৌকার কাছে যেতেই সোহেল বললেন, নদীতে মাছ মাছ নাই। অনেক কষ্টে ধারদেনা করে বাচ্চার পোশাক কিনছি। নিজেরা অহনও (এখনও) লই নাই। বাজারে গেছিলাম দুই জনার কাপড় চোপর কিনতে, দাম কইল দুই হাজার টাকার বেশি। এত টাকা কই পাবো?
এই হতাশার গল্প শুধু এই দুই পরিবারেরই নয়। ঈদকে সামনে রেখে মান্তা পল্লীর অধিকাংশ পরিবারের উৎসবের গল্পে এমন করুন সুর বাজছে। মান্তা সম্প্রদায়ের লোকজনের ভাষ্যমতে- গাঙে (নদীতে) তেমন মাছ নেই, ঈদের আনন্দ নেই। ঈদ মানেই তাদের কাছে শুধুই বিলাসিতা। নদীই মান্তা সম্প্রদায়ের জীবন। কিন্তু এবার ঈদের আগে সেই নদীর বুকে নৌকাগুলোতে কেবল হতাশা আর দারিদ্রের ছাপ।
ঝুমুর বেগমের মতো মায়েরা সন্তানদের নতুন জামা দিতে পারেননি, পুরনো কাপড় ধুয়ে ঈদের দিন কাটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সোহেল মাঝির মতো বাবারা ঈদের বাজারে গিয়ে সন্তানের জন্য কিছু কিনলেও নিজেদের জন্য কিনতে পারেননি। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিরে এসেছেন শূন্য হাতে। শহীদ হাওলাদারের মতো জেলেরা কাজ হারিয়ে নৌকার ছইয়ে শুয়ে থাকেন। দিন পার করেন দুশ্চিন্তায়। গ্রামের বাজারে ঈদের বাজার জমজমাট। কিন্তু মান্তা পল্লীতে নেই কোনো খুশির ঝলকানি। নেই ভালো খাবার, নেই নতুন পোশাকের তেমন আয়োজন। ঈদের চাঁদ উঠলেও হয়তো তাদের ঘরে আলো আসবে।
মান্তা সম্প্রদায়ের লোকজন জানান, তাদের ঈদ নির্ভর করে নদীতে ভাসা মাছের ওপর। শেষ মুহূর্তে যদি ভাল মাছ ধরা পরে, তবেই হবে ঈদ। আর মাছ না পেলে এবারের ঈদের আনন্দ আধরাই থেকে যাবে তাদের জীবনে। এ বিষয়ে কথা হয় মান্তা শিশুদের পড়াশোনা করানো শিশু বাগান স্কুলের শিক্ষক আইয়ুব খানের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে নতুন দিনের স্বপ্ন। কিন্তু মান্তা সম্প্রদায়ের কাছে ঈদ মানে শুধুই আরেকটি দিন, যেখানে নতুন পোশাক বা ভালো খাবারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাগ্যের সহায়তা।
ভাগ্যের এই খেলায় তারা বড্ড অসহায়, তবুও আশায় বুক বাঁধে-হয়তো এবার ঈদের দিনটি একটু আলাদা হবে মান্তা সম্প্রদায়ের জীবনে। শেষ মুহূর্তে ভাল মাছ মিললেই শিশুদের জন্য আসতে পারে নতুন জামা, পরিবারগুলোর পাতে উঠতে পারে একটু ভাল খাবার। ঈদের দিনে নদীর জলেও প্রতিফলিত হতে পারে তাদের হাসির ঝিলিক।