
প্রিন্ট: ২১ মার্চ ২০২৫, ১১:০৪ পিএম
ঈদযাত্রায় যানজট ও ভোগান্তির কারণ হতে পারে গাজীপুরে শ্রমিক আন্দোলন

মোহাম্মদ মোরশেদ আলম, গাজীপুর
প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২৫, ০৬:০৪ পিএম

আরও পড়ুন
দেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ যেন নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছে। ঈদ বোনাস, ছুটির তারতম্য ও বকেয়া বেতনের জন্য প্রায়ই বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধের মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছেন শ্রমিকরা। সামনে ঈদ। ঈদের সময় রাজধানীর কর্মজীবী মানুষ নাড়ির টানে বাড়িতে যান। এতে সব সড়কে বাড়তি চাপ পড়ে। তবে বেশি চাপ থাকে গাজীপুরের সড়কগুলোতে। ঈদের আগে গাজীপুরের শ্রমিকরা কর্মসূচি পালন করলে তা ঈদযাত্রায় যানজট ও ভোগান্তির কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন প্রশাসন ও বিশিষ্টজনরা।
এদিকে বেশ কয়েক দিন ধরে নানা দাবি ও উসকানিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভ, মহাসড়ক অবরোধ যেন থামছেই না। এতে জনভোগান্তি ও অর্থনৈতিক ক্ষতিগ্রস্তের পাশাপাশি ক্ষয়ে যাচ্ছে এ শিল্পের সুনাম।
শিল্প অধ্যুষিত গাজীপুর জেলায় ২ হাজার ১৭৬টি নিবন্ধিত কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ১৫৪টি তৈরি পোশাক শিল্প কারখানা। এর বাহিরে আরও ছোট ও মাঝারি অজস্র কারখানা রয়েছে। এ পর্যন্ত পোশাক শিল্পে যতগুলো আন্দোলন হয়েছে, তার প্রায় অধিকাংশ বেতন-ভাতা ও চাকরিচ্যুত কেন্দ্রিক।
শিল্প পুলিশ ও কলকারখানা অধিদপ্তরের সূত্রে জানা যায়, দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ডিসেম্বর পর্যন্ত গাজীপুরে অর্ধশত শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়াও চলতি বছরে বেক্সিমকো ও কেয়া কারখানা মিলিয়ে আরও ২০টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার কর্মহারা অর্ধ লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর দিনযাপন করছে। বন্ধ থাকা কারখানার এসব শ্রমিকের অনেকেই কারখানা খুলে দেওয়া ও বকেয়া বেতনের দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। প্রায়ই বন্ধ থাকছে মহাসড়ক। এসব শ্রমিকদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
শিল্প পুলিশ ও বিভিন্ন কারখানার মালিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে কিছু ন্যায্য ও অন্যায্য দাবি করে থাকে শ্রমিকরা। এসবের মধ্যে ন্যায্য দাবিগুলো হলো ছুটির টাকা, হাজিরা বোনাস, বকেয়া বেতন ও পদোন্নতি। এছাড়াও কিছু অযৌক্তিক দাবি তুলেন সেগুলো হলো হুটহাট বেতন বাড়ানো, দ্রুত স্থায়ীকরণ, অভিজ্ঞ আর অভিজ্ঞ শ্রমিকদের সম অধিকারের দাবি, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদত্যাগ দাবি, উৎপাদন বন্ধ রাখা ইত্যাদি। এছাড়াও শ্রমিক অসন্তোষ এর পেছনে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন, শ্রমিক নেতাদের সঠিক রোলপ্লে না করা, গুজবে কান দেওয়ার মতো ঘটনা কাজ করে।
কারখানার মালিক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শ্রমিক অসন্তোষের কারণে যদি মাঝারি আকারের একটি কারখানা একদিন বন্ধ থাকে, তবে ৭০ লাখ থেকে এক কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এছাড়াও বড় কারখানা ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি। শুধু আর্থিক ক্ষতি নয় এটি পণ্য অর্ডারের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে। শ্রমিক অসন্তোষের নতুন একটি রূপ নিয়েছে যেটি আগে ছিল না। বর্তমানে শ্রমিক অসন্তোষ হলেই কারখানার কর্মকর্তাদের মারধর ও ভাঙচুর অগ্নিকাণ্ডের জড়িয়ে পড়ে তারা। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপরও আক্রমণ করে বসে। বেতন ভাতার যে দাবি এটি অনেক সময় অর্থনৈতিক কারণেও ব্যাঘাত ঘটে। বিশেষ করে গাজীপুরে বিভিন্ন শিল্প কারখানায় গ্যাসের সমস্যা রয়েছে। গ্যাসের সমস্যা থাকলে উৎপাদন অনেক কম হয়। আর উৎপাদন কম হলেই বেতন ভাতা পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হয় মালিকদের।
বিজিএমইএ সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে ২ হাজার ১০৭টি পোশাক শিল্প কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৯৪০টি কারখানা শনিবার পর্যন্ত ফেব্রুয়ারি মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধ করে দিয়েছে। তবে ১৬৭টি কারখানা এখনো ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন পরিশোধ করতে পারেনি। এর মধ্যে ৪০ কারখানা বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বৃহস্পতিবারের মধ্যে সব কারখানায় ঈদ বোনাস পরিশোধ করতে পারবে বলে আশাবাদী তারা।
বিজিএমইএ থেকে নির্দেশনা রয়েছে- আগামী ২০ মার্চের মধ্যে সব কারখানার ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন, ঈদের বোনাস ও মার্চ মাসের অর্ধেক বেতন পরিশোধ করার। তবে এখন পর্যন্ত কোনো কোনো কারখানায় ঈদের বোনাস দেওয়া হয়নি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঈদের বোনাস না পেলে সন্তোষ দেখা দিতে পারে। এজন্য গাজীপুর শিল্প পুলিশ ২ থেকে শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে সচেতনতা সতর্কতামূলক লিফলেট বিতরণ ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। শৃঙ্খলা ফেরাতে বর্তমানে ৫৫০ জন শিল্প পুলিশের সদস্য নিয়োজিত রয়েছে, এছাড়াও ঈদের আগে ৬০০ জন করা হবে। তারা শিল্প মালিক ও শ্রমিকদের মাঝে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছেন।
আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে শ্রমিক অসন্তোষ নিরসন ও শ্রম পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে মনিটরিং করতে শ্রমিক হেল্পলাইন নম্বর ১৬৩৫৭ (টোল ফ্রি) চালু করা হয়েছে। আরএমজি এবং নন-আরএমজি সেক্টরের শ্রম অসন্তোষ নিরসন ও শ্রম পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে মনিটরিংয়ের লক্ষ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এ হেল্পলাইন নম্বর চালু করেছে। শ্রমিক অসন্তোষ জানাতে শ্রমিক হেল্পলাইন নম্বরটি ১৬৩৫৭ টোল ফ্রি।
গাজীপুরে বেতন-বোনাসের দাবিতে, কখনো তৃতীয় পক্ষের উসকানি ও রাজনৈতিক কারণে:
গত ১৪ মাসে ৬৪ দিন শ্রমিকরা উত্তাল ছিলেন গাজীপুর। এসব ঘটনার জের ধরে ঘটে বিক্ষোভ, সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, ভাঙচুর ও অগ্নিকাণ্ড। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষও হয়েছে অনেকবার। আহত হয়েছেন শত শত মানুষ। আটক হয়েছেন অন্তত অর্ধশত লোক।
জানা যায়, ২০২৪ সালে জানুয়ারিতে ৭ দিন, ফেব্রুয়ারিতে ১ দিন, মার্চে ৫ দিন, জুনে ১ দিন, জুলাইয়ে ২ দিন, আগস্টে ৪ দিন, সেপ্টেম্বরে ৮ দিন, অক্টোবরে ৪ দিন, নভেম্বরে ১৪ দিন ও ডিসেম্বরে ৫ দিন শ্রমিক আন্দোলন চলে। এছাড়াও চলতি বছরের ১৭ দিন শ্রমিক আন্দোলন ও অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে।
অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-শ্রমিক-জনতার আন্দোলনের সংগঠক আরমান হোসাইন বলেন, ২৪-এর অভ্যুত্থানের পর শ্রমিক অঞ্চলগুলোতে শ্রমিকরা তাদের দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে তার মধ্যে গাজীপুর অন্যতম, লাগাতার চলে আসছে এই আন্দোলন। পোশাক খাতে অসন্তোষ এর প্রধান কারণ বকেয়া বেতন ও শ্রমিকদের জীবন মানের উন্নতি, এ বিষয়গুলো বরাবর এড়িয়ে গিয়ে শ্রমিকদের উপরে দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের কেন অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন গঠন সুযোগ নেই, যার মাধ্যমে শ্রমিক তার কারখানার অভ্যন্তরেই সমাধানের সিদ্ধান্ত নিতে পারত। কোনো কোনো কারখানার মালিকপক্ষ আন্দোলনে থাকা শ্রমিকদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে, কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে, এবং শ্রমিক ছাঁটাই করে কালো তালিকাভুক্ত রাখায় শ্রমিকদের ভেতর অসন্তোষ চলমান রয়েছে। অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ও জীবন জীবিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করলেই শ্রমিক অঞ্চলগুলোতে অসন্তোষ থামা সম্ভব।
গাজীপুর শিল্প পুলিশ-২ এর পুলিশ সুপার একেএম জহিরুল ইসলাম বলেন, ইতোমধ্যে অনেকগুলো কারখানা বন্ধ হয়েছে। এসব কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানা বেতনের দাবিতে গত কয়েক দিন বিক্ষোভ করেছে। ঈদ বোনাস, ছুটির তারতম্য ও বকেয়া বেতনের জন্য শ্রমিকেরা ঈদের আগে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধের মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে। আশা করছি, এ সপ্তাহের মধ্যে ঈদ বোনাস দিয়ে দেবে। আমরা শিল্প পুলিশ সচেতনতামূলক লিফটের বিতরণ করছি শ্রমিকদের মধ্যে। পরিস্থিতি যেন স্বাভাবিক থাকে এজন্য শিল্প পুলিশের সাড়ে ৫ শতাধিক সদস্য ও বিভিন্ন জোনের কর্মকর্তারা কাজ করছেন।