কোটালীপাড়ায় হাসিনার বিশেষ বরাদ্দ ৭৭ প্রকল্পের ১১ কোটি টাকাই লোপাট

এসএম হুমায়ুন কবীর, গোপালগঞ্জ ও এইচএম মেহেদী হাসানাত, কোটালীপাড়া
প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৫, ০৪:০০ পিএম

শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় গত অর্থবছরে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বরাদ্দের ৭৭টি প্রকল্পের (কাবিটা) প্রায় ১০ কোটি ৮৪ লাখ ৫০০ টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনি এলাকার প্রতিনিধি শহিদ উল্লা খন্দকারসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
আত্মীয়স্বজন ও নিজের লোকদের দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠন এবং নামসর্বস্ব কাজ করে এসব কাজের টাকা হাতিয়ে নেন তারা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার কর্মসূচির আওতায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনি এলাকার প্রতিনিধি ও সাবেক সচিব শহিদ উল্লা খন্দকারের প্রচেষ্টায় ৭৭টি প্রকল্প গ্রহণ এবং অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৬৫টি প্রকল্পের বিপরীতে ১৫ কোটি ৭৯ লাখ ৮৭ হাজার টাকা এবং ১২টি প্রকল্পের বিপরীতে ৪ কোটি ৬৫ লাখ ৮৩ হাজার টাকা মোট ২০ কোটি ৪৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা বিশেষ বরাদ্দ হয়।
এসব প্রকল্পের মধ্যে শহিদ উল্লা খন্দকার নিজেই করেন ১৭টি প্রকল্পের কাজ। এর মধ্যে কাচারীভিটা ঈদগাহ মাঠের মাটি ভরাট ছাড়া বাকি ১৬ প্রকল্পের কাজ আত্মীয়স্বজন ও নিজের লোকদের দিয়ে করিয়েছেন। এছাড়া বাকি প্রকল্পগুলো উপজেলা চেয়ারম্যান বিমল কৃষ্ণ বিশ্বাস, পৌরসভার সাবেক মেয়র কামাল হোসেন শেখ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আয়নাল হেসেন শেখসহ শহিদ উল্লা খন্দকারের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভাগবাটোয়ারা করে নেয়।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য মতে, বাস্তবায়ন হয়েছে এমন সব প্রকল্পের চূড়ান্ত বিল উত্তোলন করে নিয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি। এর মধ্যে অধিকাংশ প্রকল্পে শতকরা ৯০-৯৭ ভাগ কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে বলে তাদের নথিতে উল্লেখ করা হয়। পাঁচ আগস্টের পর মোট বরাদ্দের ৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়া হয়েছে। সে হিসাবে কাজ হয়েছে ১৬ কোটি ৬৭ লাখ ৭০ হাজার টাকার কাজ।
স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ৭৭টি প্রকল্পের সবগুলোই দায়সারা গোছের কাজ করে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
তাদের দাবি, গড়ে ৩৫ শতাংশ কাজ হয়েছে; বাকি টাকা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি আত্মসাৎ করেছেন। সে হিসাবে কাজ হয়েছে প্রায় ৫ কোটি ৮৩ লাখ ৬৯ হাজার টাকার। বাকি প্রায় ১০ কোটি ৮৪ লাখ ৫০০ টাকা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে।
জানা যায়-কোটালীপাড়ায় মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির, এতিমখানা, স্কুল, কবরস্থান, বয়স্ক মহিলাদের কুরআন শিক্ষা কেন্দ্র, হেফজখানা, খ্রিস্টান মিশন, ডগলাস মেমোরিয়ার স্কুল, ঈদগাহ, সরকারি খাস জায়গা ও কওমি মাদ্রাসায় মাঠ মাটি দিয়ে ভরাট, গ্রামীণ সড়ক ও এইচবিবি রাস্তা নির্মাণ ইত্যাদি উন্নয়ন ও সংস্কারে ৭৭ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
সরেজমিন সোমবার দুপুরে কোটালীপাড়ার সাদুল্যাপুর ইউনিয়নের ডগলাস মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে মাঠের দক্ষিণ পাশে কিছু অংশ মাটি দিয়ে ভরাট করা দেখা গেছে। বালু ভরাটের ওই জায়গায় একটি সাইন বোর্ড টানানো রয়েছে। সেখানে লেখা ‘ক্রয় সূত্রে জায়গার মালিক রাসেল মোল্লা ও বাধনগং’।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাসেল ও বাধন শহিদ উল্লা খন্দকারের আত্মীয়। প্রকল্পের টাকায় বিদ্যালয়ের মাঠ ভরাটের নামে ব্যক্তিগত জায়গা ভরাট করা হয়েছে। এই প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৩৯ লাখ ১৬ হাজার টাকা। একই ইউনিয়নের নারিকেলবাড়ি গ্রামের গাবভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একই চিত্র দেখা যায়। ওই স্কুলের মাঠের কিছু অংশ মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। মাঠের উত্তর পাশে শহিদ উল্লা খন্দকারের সম্পর্কে চাচাতো ভাই মতলেব খন্দকার গংয়ের জমি। স্কুলের বরাদ্দের টাকা দিয়ে ওই জমি ভরাট করা হয়। কথা হয় নারিকেলবাড়ি গ্রামের বিষ্ণু পদ হালদারের সঙ্গে।
তিনি জানান, ওই স্কুলের উত্তর পাশের জমি তার চাচাতো ভাইয়ের। মাঠ ভরাট করার সময় মতলেব ও তার অন্য শরিকদের জায়গাও ভরাট করা হয়েছে। মূলত স্কুলের জায়গা ৫২ শতাংশ। এর মধ্যে ভবন ও সামনের প্রায় অধের্ক অংশে আগে থেকেই ভিটে (মাটি দিয়ে উঁচু) করা ছিল।
তার ধারণা, স্কুলের মাঠ সংস্কারে সর্বোচ্চ ২-৩ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। যদিও বরাদ্দ ছিল ৪৯ লাখ ২৩ হাজার টাকা।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আদর্শ সরকারি মহাবিদ্যালয়ের মাঠ ও পুকুরপাড় পূর্ব থেকেই ভরাট করা থাকলেও সংস্কারের নামে শহিদ উল্লা খন্দকার ১৭ লাখ টাকা নতুন করে বরাদ্দ নিয়ে আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। রামশীল মধ্যপাড়ার রবি বাড়ৈর দোকান থেকে অনিন্দ সরকারের বাড়ি পর্যন্ত পুরাতন রাস্তার ওপর সামান্য কিছু কাজ করে ২১ লাখ ৯০ হাজার টাকা উত্তোলন করেন শহিদ উল্লা খন্দকার।
অনুসন্ধানে শহিদ উল্লা খন্দকারের নিজের ১৭টি প্রকল্পের সবকটিতে অনিয়মের চিত্র বেরিয়ে আসে। এসব প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করতে তিনি নিজ বাড়ির মসজিদের ইমাম মাওলানা ইয়াহিয়া এবং নিজের ঘনিষ্ঠজনদের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি করেন। ৫ জুলাই ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর শহিদ উল্লা খন্দকার তড়িঘড়ি করে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজের চূড়ান্ত বিলের টাকা উত্তোলন করে লাপাত্তা হয়ে যান।
গুঞ্জন রয়েছে, তিনি দেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এইচএম আনসার বলেন, তিনি নতুন যোগদান করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বরাদ্দের কাজগুলো এখন পর্যন্ত তার দেখাই হয়নি।