Logo
Logo
×

শেষ পাতা

বাঘায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল আ.লীগের আক্কাছ

পৌরসভার তহবিল তছরুপ, চোরাচালান, মাদক পাচার, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, হত্যাকাণ্ড-এমন অপরাধ নেই যা করেনি

Icon

রাজশাহী ব্যুরো

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাঘায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল আ.লীগের আক্কাছ

রাজশাহীর বাঘা পৌরসভার সাবেক মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আক্কাছ আলী। ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহীর বাঘা পৌরসভার সাবেক মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আক্কাছ আলী গত ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত এলাকায় ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক। আওয়ামী লীগের টানা ১৬ বছরের শাসনামলে দলীয় কোন্দলে কিছু সময় কোণঠাসা থাকলেও বাকি সময় তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে বাঘায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। এখন বাঘার মানুষের মুখে মুখে ফিরছে পলাতক আক্কাছের অপরাধের কাহিনী।

সর্বশেষ ২০২৪ সালের ২২ জুন উপজেলা পরিষদ চত্বরে প্রকাশ্যে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বাবুল ইসলামকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যায় নেতৃত্ব দেন আক্কাছ। নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। গ্রেফতার হয়ে কিছুদিন ছিলেন কারাগারে। জুলাই আন্দোলনের শুরুর দিকে জামিনে মুক্ত হয়ে এলাকা ছাড়েন। আক্কাছের পাকুড়িয়ার কলিগ্রামের বিশাল বাড়িটি এখন সুনসান। আক্কাছ এলাকা ছাড়লেও তার ভয়াল স্মৃতি এখনো বাঘার মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়। গত অক্টোবরে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন আক্কাছের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে।

সরেজমিন এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান আক্কাছের বাবার নাম চৈতি মন্ডল। সীমান্ত এলাকায় বাড়ি হওয়ায় আক্কাছ ছোটকালেই সীমান্ত চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীতে ভারত থেকে আসা অবৈধ মালামালের জন্য চাঁদা আদায় শুরু করেন। এভাবে আক্কাছ তৎকালীন বিডিআর ও পুলিশের প্রধান দালাল হয়ে কাজ শুরু করেন। ফলে তিনি হয়ে উঠেন এলাকার চোরাকারবারিদের গডফাদার। সীমান্তের ঘাটগুলো দিয়ে আসা চোরাচালান পণ্য আনতে আক্কাছকে নজরানা দিতে হতো।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, স্কুল পাশ করে আক্কাছ ১৯৯১ সালে বাঘা শাহদৌলা কলেজে ভর্তি হন। ব্যাপক প্রভাব তৈরি করে কলেজের ভিপি হন। একসময় হন উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আক্কাছ হয়ে উঠেন এলাকায় ক্ষমতাসীন রাজনীতির মধ্যমণি। গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী বাহিনী। নেতাদের ম্যানেজ করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন আক্কাছ। সন্ত্রাসী বাহিনীর সাহায্যে জিম্মি করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন বাঘা এলাকাজুড়ে। মদ্যপ অবস্থায় পুলিশের উপরেও একাধিকবার হামলা করেছেন। দুই দফা হন বাঘা পৌরসভার মেয়র। জীবনে সাতবার গ্রেফতার হয়ে কারাবাস করেছেন। তবে অর্থ ও ক্ষমতার প্রভাবে প্রতিবারই দ্রুত সময়ে জামিনে মুক্ত হয়েছেন।

আক্কাছের বেপরোয়া সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে বাঘা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ফখরুল হাসান বাবলু বলেন, আক্কাছ আলী সম্পর্কে আলাদা করে কিছু বলার নেই। পৌরসভার তহবিল তছরুপ থেকে শুরু করে চোরাচালান, মাদক পাচার, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, টেন্ডারবাজি, হাট-ঘাট থেকে বেপরোয়া চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, হত্যাকাণ্ড-এই জীবনে সব অপরাধই করেছেন তিনি। সংক্ষেপে তার অপরাধের ফিরিস্তি দেওয়া সম্ভব নয়। যতদূর জানি আক্কাছের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে ২৫টি মামলা রয়েছে। থানায় শতাধিক জিডি থাকার কথা শুনেছিলাম কয়েক বছর আগেই। আক্কাছবিহীন বাঘার মানুষ এখন মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারছে।

এদিকে বাঘা থানা পুলিশের অপরাধ রেকর্ড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের আমলেই আক্কাছ আলীকে সন্ত্রাসীদের গডফাদার বলে ঘোষণা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আক্কাছ আলীর সর্বশেষ প্রোফাইলে হত্যা ও ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধে মোট ২৫টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। সাধারণ ডায়েরির সংখ্যা শতাধিক। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো জেলা পুলিশের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯৬ সালের জুলাইয়ে মদ্যপ অবস্থায় বাঘা বাজার বাসস্ট্যান্ডে এক আওয়ামী লীগ কর্মীর বোনকে বিবস্ত্র করে দেশব্যাপী আলোচনায় আসেন আক্কাছ। ওই সময় আক্কাছ আলী দলীয় পদ হারান এবং গ্রেফতার হয়ে কারাবাসও করেন। ২০১২ সালের ২৮ এপ্রিল বাঘা থানা পুলিশের তৎকালীন উপপরিদর্শক সোহেল আহাম্মেদকে থানায় ঢুকে মারধরের অভিযোগে আক্কাছ আলীর নামে মামলা হয়। ২০১৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর জেলা জজ আদালতের নাজিরসহ আদালতের ৬ কর্মচারীকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেন আক্কাছ ও তার সহযোগীরা। আদালতের কর্মচারীরা বাঘায় একটি সম্পত্তি প্রকৃত মালিককে বুঝিয়ে দিতে গিয়েছিলেন। এ ঘটনায় মামলা হলে আক্কাছ আলীকে গ্রেফতার করা হয়।

অন্যদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাঘার একজন স্কুল শিক্ষক বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে বাঘা উচ্চবিদ্যালয়ে বিজয় মঞ্চের আয়োজন করা হয়। সেখানে প্রধান অতিথি হন আক্কাছ। মাতাল অবস্থায় মঞ্চে উঠে এক ছাত্রীকে প্রকাশ্যে জড়িয়ে ধরেন। এ ঘটনার পর অনুষ্ঠানটি পণ্ড হয়ে যায়। মেয়র থাকাকালে আক্কাছ পৌর ভবনে বসে মদপান করে মাতলামি করছিলেন। এ সময় পৌরসভার তিনজন নারী কাউন্সিলরের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। এ ঘটনায় পৌরসভার ৯ জন কাউন্সিলর থানায় আক্কাছের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। এই ঘটনার কয়েকদিন পর উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামের এক গৃহবধূকে মাতাল অবস্থায় ধর্ষণের চেষ্টা করে আবার আলোচনায় আসেন আক্কাছ। ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে বাঘা থানায় তার নামে মামলা করেন ওই গৃহবধূর মা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আক্কাছ আলী ২০২২ সালের ২১ মার্চ কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনেই বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে হামলা চালালে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। ২০২৪ সালের ২২ জুন বাঘা উপজেলা পরিষদ চত্বরের সামনে সকাল ১০টায় তার অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে উপজেলা আওয়ামী লীগের ব্যানারে মানববন্ধন হয়। কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের ওপর হামলা চালান আক্কাছ আলীসহ তার ক্যাডার বাহিনী। আক্কাছ বাহিনীর হামলায় নিহত হন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুল। এই ঘটনায় আক্কাছের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হলে পুলিশ তাকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করে। তবে প্রভাব খাটিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই জামিনে মুক্ত হয়ে যান। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে আক্কাছ আলী পরিবারসহ এলাকা ছেড়ে আত্মগোপন করেন।

আক্কাছের সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল আলম বলেন, জুলাইয়ের প্রথমদিকে জামিনে মুক্ত হওয়ার পর আক্কাছকে এলাকায় আর দেখা যায়নি বলে শুনেছি। তার অপরাধের ফিরিস্তি অনেক লম্বা। আক্কাছ পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী গডফাদার। পুলিশ তার অবস্থান শনাক্ত করে গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

এদিকে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আক্কাছ গত ১৬ বছরে প্রভাব খাটিয়ে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন। রাজশাহী ও বাঘা ছাড়াও ঢাকায় তার বিপুল সম্পদ রয়েছে। দুদক ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে দুটি দুর্নীতির মামলা করেছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম