শিশু ধর্ষণ আড়াল করতে ‘ট্রিপল’ মার্ডার

এ টি এম নিজাম, কিশোরগঞ্জ
প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২৫, ১০:২২ এএম

প্রতীকী ছবি
শিশু ধর্ষণের ঘটনা আড়াল করতে করা হয় ট্রিপল মার্ডার। এ ঘটনায় চার্জশিট দেওয়ার পরও অদৃশ্য ক্ষমতাবলে জামিনে মুক্ত আসামি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটি কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের সাহেদল ইউনিয়নের বাসুরচর গ্রামের ২০২৩ সালের দেশব্যাপী আলোচনায় আসা চাঞ্চল্যকর ও লোমহর্ষক ঘটনা। এ পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন মামলার বাদী ও স্বজনরা।
জানা গেছে, বাসুরচর গ্রামের মঞ্জিল মিয়া ২০১৮ স্ত্রী তাছলিমা আক্তার (৩৫), দুই মেয়ে মোহনা আক্তার (১১) ও বন্যা আক্তারকে (০৭) রেখে সৌদি আরব পাড়ি জমান। ২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর সকালে মোহনাকে স্কুলে নিয়ে যেতে এক সহপাঠী তাদের বাড়িতে যায়। অনেক ডেকে সাড়া না পেয়ে ঘরের দরজায় ধাক্কা দিতেই তা খুলে যায়। পরে ভেতরে গিয়ে তাছলিমা আক্তার ও তার দুই শিশুকন্যার দেহ নিথর পড়ে থাকতে দেখে সে চিৎকার দেয়। তার চিৎকারে প্রতিবেশীরা সেখানে ছুটে আসেন। এরপর পুলিশ ওই বাড়ি থেকে মা ও দুই শিশুর লাশ উদ্ধার করে।
পরদিন ১৫ নভেম্বর হোসেনপুর থানায় নিহত তাছলিমার ভাই কবিরুল ইসলাম নয়ন অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা মামলা করেন। এর সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ১৫ নভেম্বর বাসুরচর গ্রাম থেকে জাহাঙ্গীর আলম (৪৭) ও জহিরুল ইসলাম ছোটন (৩৫) নামে দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ মামলার মূল তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন হোসেনপুর থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদুজ্জামান টিটু। তিনি জানান, জাহাঙ্গীর আলমকে যখন আমরা গ্রেফতার করি তখন তার হাতে অনেক নখের আঁচড় ছিল। তারপর আমরা দেখলাম জাহাঙ্গীর ও নিহত তাছলিমার সঙ্গে ইমুতে যোগাযোগ ছিল। মোবাইল ফোনের কথোপকথন যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ সৃষ্টি করে যে তাদের মধ্যে পরকীয়া সম্পর্ক রয়েছে।
এ সূত্র ধরে আমরা অগ্রসর হই এবং প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারি জাহাঙ্গীর রাতে বা দিনে বা সময়-অসময়ে ওই বাড়িতে যাওয়া-আসা করত। তখন আমরা সিআইডির সহযোগিতায় তাছলিমা ও তার দুই শিশুর নখ থেকে প্রাপ্ত নমুনা ও ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করে ফরেনসিক বিভাগে পাঠাই। রিপোর্ট আসে যে, নিহত তিনজনেরই নখের মধ্যে জাহাঙ্গীর আলমের ডিএনএ পাওয়া গেছে। নিহতদের নখের ভেতরে যেহেতু আসামির ডিএনএ পাওয়া গেছে, সেক্ষেত্রে আমরা নিশ্চিত হয়েই জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করি।
আমরা যতদূর জানি, আসামি আদালত থেকে দীর্ঘদিন ধরে জামিনে রয়েছে। পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্র জানায়, তাছলিমার সঙ্গে জাহাঙ্গীরের সম্পর্ক ছিল। সে সম্পর্কের কারণে প্রায়ই তাছলিমার বাসায় যাতায়াত করত জাহাঙ্গীর। তাছলিমার সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যেই বড় মেয়ে মোহনা আক্তারের প্রতি তার কুনজর পড়ে। ঘটনার রাতে তাছলিমাই ঘরের দরজা খুলে দিয়ে ঘরে প্রবেশ করায় তাকে। পরে কোনো এক মুহূর্তে মোহনাকে ধর্ষণ করার সময় তাছলিমা এবং অন্য শিশু দেখে ফেলে। ধর্ষণের এ ঘটনাকে ধামাচাপা দিতেই তাছলিমা ও তার দুই শিশুকন্যাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে জাহাঙ্গীর।
২০২৪ সালের ৩১ জুলাই আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার দ্বিতীয় তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক নাহিদ হাসান সুমন। আদালতে দাখিল করা চার্জশিটের বিবরণ থেকে জানা গেছে, নিহত তাছলিমার বাসায় প্রায়ই যেত আসামি জাহাঙ্গীর।
ঘটনার রাতে সে নিহত তাছলিমার বাসায় গিয়ে বড় মেয়ে মোহনাকে ধর্ষণ করে। ঘটনা ধামাচাপা দিতে ও ভবিষ্যতে যেন কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকে এজন্য তাছলিমা ও তার দুই শিশুকন্যাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে। ফরেনসিক পরীক্ষায় বিশেষজ্ঞ মতামতের প্রেক্ষিতে এ ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের সময় আসামি জাহাঙ্গীর ঘটনাস্থলে উপস্থিতি ছিল সেটা নিশ্চিত ভাবেই প্রমাণিত। অন্যদিকে এ ঘটনার তদন্তে জহিরুল ইসলাম ছোটনের বিরুদ্ধে জড়িত মর্মে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
মামলার বাদী কবিরুল ইসলাম নয়ন বলেন, আমার বোন এবং ভাগনিকে হত্যাকারী জাহাঙ্গীর হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছে। প্রায়ই জাহাঙ্গীর আমার সামনে এসে ঘোরাঘুরি করে। আমাকে প্রায়ই হুমকি দেয় ও লোকজন ধরে বিভিন্ন প্রলোভন দেখায়। আমি শুধু বোন এবং ভাগনির সঙ্গে যা ঘটছে তার বিচার চাই।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এ এম ছাজ্জাদুল হক সাজ্জাদ বলেন, আসামি হাইকোর্ট থেকে জামিনে আছে। মামলার চার্জশিট হয়েছে। সাক্ষীর স্টেজে আসবে। যেহেতু মামলাটি চাঞ্চল্যকর সেহেতু আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।