কৃষকের ছেলে ‘মাফিয়া দালাল’ শওকতের যত অপরাধ

মাদারীপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২৫, ০৪:১৮ পিএম

কৃষকের ছেলে থেকে মাফিয়া দালাল হয়ে উঠেছে মাদারীপুর রাজৈর উপজেলার কবিরাজপুরের বাসিন্দা শওকত আকন। লিবিয়ায় অবস্থান থাকা এ আদম ব্যবসায়ী ইতালি নেওয়ার কথা বলে মানুষকে আফ্রিকার দেশটিতে নিয়ে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেখানে নিয়ে নির্যাতন ও দেশ থেকে টাকা নেওয়ার কথা জানিয়েছে ভুক্তভোগীর স্বজনেরা। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে হয়েছে আদালতে মামলাও।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, প্রলোভন দেখিয়ে ইতালি নেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে
যায় শওকত। সেখানে নিয়ে করা হয় নির্যাতন। দেশ থেকে ভুক্তভোগীর স্বজনদের কাছ থেকে নেওয়া
বিপুল অর্থ। শওকতের নির্যাতনে লিবিয়ায় প্রাণ হারিয়েছে কয়েকজন বাংলাদেশিও। আদম ব্যবসা
করে বিপুল অর্থের মালিক বনে গেছেন কৃষকের ছেলে শওকত। স্থানীয় প্রভাবশালী ও প্রশাসনকে
ম্যানেজ করে তিনি চালিয়ে যাচ্ছে অপকর্ম। এ জন্য তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে ভয় পান ভুক্তভোগীরা।
সম্প্রতি মাফিয়া দালাল শওকতের কাছে জিম্মি থাকা তিন বাংলাদেশির মৃত্যুর
হওয়ার খবর পেয়েছে নিহতদের পরিবার। পরিবারগুলোর ধারণা, নির্যাতনের জেরেই তাদের মৃত্যু
হয়েছে। এছাড়া এখনও প্রায় ৩৫ জন বাংলাদেশি শওকতের কাছে জিম্মি রয়েছে বলে জানা গেছে।
এ ৩৫ জনের পরিবারের কাছ থেকে তিনি হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কবিরাজপুর ইউনিয়নের শ্রীকৃষ্ণদী গ্রামে ফসলি
জমির মাঝে একটি টিনের ঘরে বসবাস করে শওকতের পরিবার। পাশেই একটি ভবনের কাজ চলছে। শওকতের
বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী ও সন্তান থাকেন ওই বাড়িতে। শওকত লিবিয়া, দুবাই ও সিঙ্গাপুর এ
তিন দেশে ঘুরে ঘুরে কাজ করে বলে পরিবারটির দাবি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শওকতের হয়ে বাংলাদেশে কাজ করে একটি চক্র। সেই
চক্র বিভিন্ন প্রলোভন ও রঙিন স্বপ্ন দেখিয়ে যুবকদের ইতালি যেতে উদ্ভুদ্ধ করে। পরে মোটা
টাকার চুক্তিতে তাদের লিবিয়ায় শওকতের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে বাংলাদেশিদের আটক
করে মারধর করে আরও টাকা দাবি করে। এভাবেই শওকত ও তার চক্র এক একটি পরিবার থেকে ৫০ লাখ
থেকে শুরু করে কোটি টাকাও আদায় করে। অনেক পরিবার জমিজমাসহ সবকিছু বিক্রি করে ছেলেকে
বাঁচাতে টাকা দিয়েছে।
সম্প্রতি লিবিয়ায় শওকতের কাছে জিম্মি থাকা রাজৈর উপজেলার দুই যুবক ও
ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার এক যুবক মারা যায়। এ ঘটনায় নিহত যুবক রফিকুল ইসলামের পরিবার
সাতজনকে আসামি করে মামলা করে। বাকি দুই পরিবারকে মোটা টাকা দেওয়ার প্রলোভন ও স্থানীয়
প্রভাবশালীদের ভয় দেখায়। এতে মামলা করার সহস করেনি তারা। এছাড়া বর্তমানে শওকতের কাছে
৩৫ বাংলাদেশি জিম্মি থাকায় ভুক্তভোগী পরিবারগুলো স্বজন হারানোর ভয়ে মুখ খুলছে না।
নিহত রফিকুল হাওলাদারের ভাই ও মামলার বাদী এবাদুল হাওলাদার বলেন, শওকতের
সঙ্গে কথা হয় ১৬ লাখ টাকা চুক্তিতে। আমার ভাইকে বিমানযোগে ইতালি নিয়ে যাওয়ার কথা বলে
লিবিয়ায় নিয়ে যায় তারা। সেখানে ভাইকে করে ২৫ লাখ টাকা দাবি করে। ভাইয়ের জীবনের কথা
চিন্তা করে দুবারে আমি ২৫ লাখ টাকা দেই। এরপর থেকে আমার ভাইর কোনো খবর পায় নাই। বিভিন্ন
মাধ্যম থেকে জানতে পারি শওকত ও তার লোকজনের নির্যাতনে আমার ভাই মারা গেছে। শওকতের সঙ্গে
যোগাযোগ করলে বিষয়টি দেখবে বলে জানায়। এরপর নিজে ফোনে ও বিভিন্ন লোকজনকে আমার কাছে
পাঠিয়ে বিষয়টি মীমাংসা করার প্রস্তাব করে। আমি তাই বাধ্য হয়ে মামলা করেছি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সোলপুর গ্রামের একাধিক ভুক্তভোগী জানান, শাওকতের
কাছে এখনও প্রায় ৩৫ জন জিম্মি আছে। এর মধ্যে হাবি হাওলাদারের ছেলে ইমন হাওলাদারের জন্য
নিয়েছে ৪০ লাখ টাকা। মৃত রহমান হাওলাদারের ছেলে কাজল হাওলাদারের কাছ থেকে নিয়েছে ৩৭
লাখ টাকা। স্বজনদের বাঁচানোর আশায় পরিবারগুলো অভিযোগ করতে সাহস পাচ্ছে না।
শওকতের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে কবিরাজপুর ছয়ফুদ্দিন ডিগ্রি কলেজের দপ্তরি
ইকবাল মাতুব্বর। তার বড় ছেলে জাহিদ হোসেন ও ছেলের বউ দুজনই পুলিশের সদস্য। আদম ব্যবসা
করে ইতিমধ্যে কোটি টাকার মালিক হয়েছেন এ দপ্তরি। একটি বেসরকারি কলেজের চতুর্থ শ্রেণির
কর্মচারি হয়েও গ্রামের বাড়িতে দিচ্ছেন ডুপ্লেক্স ভবন। ইকবালের স্ত্রীর দাবি, তার স্বামীকে
সবাই বিশ্বাস করে। তাই ইকবালের মাধ্যমে শওকতকে টাকা দেয় সবাই। আর ইকবাল একা এই কাজ
করে না। অনেকেই শাওকতের সঙ্গে এ কাজ করে।
শরীয়তপুরে কর্মরত ইকবালের ছেলের বউ পুলিশ সদস্য তানিয়া বলেন, ‘আমার শ্বশুর কীভাবে ডুপ্লেক্স বাড়ি করছে তা আমি জানি না। তিনি আদম ব্যবসা করে কি না তাও আমার জানা নেই। আমরা স্বামী-স্ত্রী চাকরি করে যা পাই তা দিয়ে আমাদের চলে যায়। মাঝে মাঝে শ্বশুর-শাশুড়িকে কিছু টাকা দেয়।
জেলা পুলিশ সুপার মো. সাইফুজ্জামান বলেন, ‘শওকত অবৈধভাবে লিবিয়া দিয়ে
ইতালি লোক পাচার করে এবং যুবকদের জিম্মি করে নির্যাতন করে পরিবারের কাছ থেকে টাকা নেয়
তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর এবাদুল হাওলাদার আদালতে যে অভিযোগ
করেছে তা তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বলেছেন আদালত। আমরা তদন্ত করছি। আদালতে রিপোর্ট দেওয়া
হবে। তারপর আদালত যে আদেশ দিবে পরবর্তীতে সে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’