বেকার যুবক থেকে ৩০০ কোটি টাকার মালিক ‘কসাই মহব্বত’

আবুল খায়ের, কুমিল্লা
প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:০৮ এএম

সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুল ইসলামের শ্যালক মহব্বত আলী ওরফে ‘কসাই মহব্বতের’ ছিলেন বেকার যুবক। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ থেকে দ্বিতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হন তাজুল ইসলাম। এরপর থেকে প্রভাব বিস্তার শুরু করেন তিনি। ২০১৮ সালে তাজুল মন্ত্রী হওয়ার পর ফুলেফেঁপে কলাগাছ বনে যান তিনি।
জানা যায়, সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুল ইসলামের শ্যালক মহব্বত আলী লাকসামের সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ক্ষমতার দাপটে গত ১৫ বছরে তিনশ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, তদবির বাণিজ্য, সালিশ-দরবার, দলের কমিটি বাণিজ্য ছিল তার টাকা কামানোর প্রধান উৎস।
স্থানীয়দের দাবি, এছাড়াও আরও কয়েকশ কোটি টাকার অদৃশ্য সম্পদের মালিক তিনি। ভিন্নমত দমনে লাকসাম থানার সামনে মহব্বত আলী গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব টর্চার সেল। তার অমানবিক নির্যাতন ও পৈশাচিক কায়দায় অর্থবিত্ত কামানোর কারণে এলাকার মানুষ তাকে ‘কসাই মহব্বত’ হিসেবে ডাকে। ৫ আগস্টের পর স্থানীয় লোকজন তার কথিত ‘আয়নাঘরে’ হামলা চালায়। তার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভের অন্ত নেই। তবে তার বিষয়ে এখনো মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
কুমিল্লার লাকসাম পৌরসভার পাইকপাড়া এলাকার আব্দুল আজিজের ছেলে মহব্বত আলী। তার বাবা ছিলেন লাকসাম বাজারে স্টিলের ট্রাঙ্ক বিক্রেতা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে একজন বেকার যুবক ছিলেন মহব্বত। ওই বছর আওয়ামী লীগের টিকিটে বোনের জামাই তাজুল ইসলাম দ্বিতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর প্রভাব বিস্তার শুরু করেন তিনি। বিনা ভোটে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানের পদ লুফে নেন। এক পর্যায়ে হয়ে ওঠেন লাকসাম এলাকার ‘গডফাদার’। গড়ে তুলেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। শুরু হয় মহব্বতের ত্রাসের রাজত্ব। থানার সালিশ দরবার, জায়গা বেচাকেনায় দালালি, জমির ক্রয়-বিক্রয়ে ঝামেলা সৃষ্টি ও চাঁদাবাজি করে কোটি কোটি টাকা কামাই করেন। ২০১৮ সালে তাজুল ইসলাম এলজিআরডি মন্ত্রী হওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যে ফুলেফেঁপে কলাগাছ বনে যান মহব্বত। লাকসাম তথা দক্ষিণ কুমিল্লার বড় বড় ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিতেন তিনি। লাকসাম পৌরসভার সব ধরনের টেন্ডার ও নানা উন্নয়ন কাজের কর্তা ছিলেন তিনি।
বোনের জামাই তাজুল ইসলামের কাছ থেকে লাকসাম পৌরসভার নামে বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ এনে নিজেই সব বাস্তবায়নসহ সুবিধা লুফে নিতেন। মা এন্টারপ্রাইজ, আলী এন্টারপ্রাইজ ও সৈয়দ আলী বিল্ডার্স নামে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এলাকার অধিকাংশ উন্নয়ন কাজের ঠিকাদারি করেছেন তিনি। তাছাড়া লাকসাম পৌরসভায় ভবনের প্ল্যান পাশ, জমি রেজিস্ট্রিসহ বিভিন্ন খাত থেকে মোটা অঙ্কের উৎকোচ হাতিয়ে নিতেন।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, লাকসাম পৌরসভার দৌলতগঞ্জ রেললাইন থেকে পৌরসভা কার্যালয়ের সামনে দিয়ে চাঁদপুর সড়ক পর্যন্ত সড়কটি নির্মাণে নয়-ছয় করার অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। স্থানীয়রা জানান, ঢাকার ডেমরা এলাকার কায়েতপাড়া পুলিশ লাইন রোডে ইকো অ্যাডভান্স কনস্ট্রাকশন মেটারিয়ালস কোম্পানি লিমিডেট নামে একটি ব্লক অ্যান্ড সিরামিক ফ্যাক্টরি, কুমিল্লা নগরীর আদালতসংলগ্ন সেল রমিজউদ্দিন ভবনে বিলাস বহুল ফ্ল্যাট, লাকসাম উত্তর বাজারে ফৌজিয়া সুপার মার্কেট, বাইপাস সড়কের পাশে ইলেকট্রনিক শোরুম, রেলওয়ে ক্লাবের পাশে নতুন বাড়ি, লাকসাম হাউজিংয়ে এক একরের বেশি জায়গা, থানার সামনে ৫০ শতাংশ জায়গা, নুশরতপুর এলাকায় ৬০ শতাংশ জায়গা, লাকসাম পৌরসভার পাইকপাড়া, বড়তুপা, ডুরিয়া-বিষ্ণপুর জংশন এলাকায় কমপক্ষে ৫০ বিঘা জমি, কুন্দ্রা এলাকায় ৩ একর জমি, মিশ্রি এলাকায় স্ত্রী জাকিয়া সুলতানা কোহিনুরের নামে ৫০ শতাংশের বাড়ি, বাইনছাতিয়া এলাকায় ২ একর জমি, ঢাকার গুলশানে ১টি ফ্ল্যাট, বান্দরবান সদরের পাহাড়ি এলাকায় ৫ একর জায়গাসহ কমপক্ষে তিনশ কোটি টাকার দৃশ্যমান সম্পদ রয়েছে এই গডফাদারের।
ডুরিয়া-বিষ্ণপুর এলাকার বাসিন্দা জোবায়ের আহমেদ বলেন, পাইকপাড়া, বড়তুপা, ডুরিয়া ও বিষ্ণপুর এলাকায় মহব্বত আলীর ৫০ বিঘার উপরে জমি রয়েছে। তার এসব জমির দাম বিঘাপ্রতি কোটি টাকার উপরে। তাছাড়া এখানে দুই-তিন কোটি টাকা বিঘা মূল্যের জমিও রয়েছে। শুধু এলাকায় নয়, বান্দরবান সদরের পাহাড়ি এলাকায় তার ৫ একর জমি রয়েছে।
পাইকপাড়া এলাকার বাসিন্দা গোলাম মোস্তফা বলেন, আমি মহব্বতের প্রতিবেশী। কুন্দ্রা এলাকায় মহব্বতের ৩ একর জমি রয়েছে। মিশ্রি এলাকায় স্ত্রী জাকিয়া সুলতানা কোহিনুরের নামে ৫০ শতাংশের বাড়ি, বাইনছাতিয়া এলাকায় ২ একর জমি রয়েছে। পাইকপাড়া এলাকার বাসিন্দা আল মদিনা প্রেসের মালিক সোলেমান মিয়া বলেন, মহব্বত ও আমি একই গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবা একসময় লাকসাম বাজারে স্টিলের ট্রাঙ্ক বিক্রি করতেন। ২০০৮ সালের আগে মহব্বত ছিলেন একজন বেকার যুবক। মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরতেন। ২০০৮ সালের পর বোনের জামাইর ক্ষমতার প্রভাবে তিনি এখন বিপুল সম্পদের মালিক।
লাকসাম উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক মোশাররফ হোসেন মশু বলেন, মহব্বতের তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে এলাকায় হাজার হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ হয়েছে। গোটা লাকসামের চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি তদবির বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ ছিল মহব্বতের হাতে। বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন লোকজনকে ধরে এনে মহব্বত ও তার ক্যাডার বাহিনীর লোকজন আয়নাঘরে আটক রেখে নির্যাতন করত।
লাকসাম উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মনির হোসেন বলেন, ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি আমাকে পুলিশ আটক করে মহব্বতের আয়নাঘরে দিয়ে আসে। মহব্বতের লোকজন আমাকে স্টিলের চেয়ারে বসিয়ে ইলেকট্রিক শক দিয়েছে। দুই দফায় আমাকে সেখানে নির্যাতন করা হয়। তাকে লাকসামের মানুষ ‘কসাই মহব্বত’ বলে ডাকে। মহব্বতকে চাঁদা না দিলে, তার সিগন্যাল ছাড়া সাবরেজিস্ট্রার জমির রেজিস্ট্রি করত না। আমার সামনেই অনেক ব্যবসায়ীকে ধরে এনে চাঁদা আদায় করেছে। অনেককে ধরে এনে খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর রেখেছে।
লাকসাম পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা পাইকারি গরু ব্যবসায়ী মো: শফিউল্লাহ বলেন, ২০২২ সালে কোরবানি ঈদের আগে মহব্বত আমার কাছে প্রতি গরু বিক্রিতে পাঁচ হাজার টাকা করে চাঁদা চায়। না দেওয়ায় মহব্বতের ক্যাডার কালা আলমগীর, মোজাম্মেল, ফারুক, হারেস, মঈন আমাকে ধরে নিয়ে আয়নাঘরে নির্যাতন করে। পরে মহব্বতকে ৫ লাখ ও তার ক্যাডারদেরকে ২ লাখ টাকা দিয়ে আমি ছাড়া পাই। পরে আমি এলাকা ছেড়ে কুমিল্লা শহরে গিয়ে আদালতে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেও বিচার পাইনি।
লাকসাম দক্ষিণ বাজারের বাসিন্দা আলী আহাম্মদ বলেন, ২০২৩ সালের শেষ দিকে আমি বাড়ি নির্মাণের একটি প্ল্যানের জন্য পৌরসভায় গিয়েছিলাম। কিন্তু মহব্বতের লোকজন আমার কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। আমি বাড়িটি নির্মাণ না করে পিছু হটি। তবে আত্মগোপনে থাকায় মহব্বতের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।