ইতালি পাঠানোর ফাঁদে মিয়ানমারে নির্যাতন-মুক্তিপণ আদায়, গ্রেফতার ৪

কালীগঞ্জ (গাজীপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:৪৪ পিএম

ইতালিতে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে কালীগঞ্জের আরিফ হোসেনকে (৪৫) ফাঁদে ফেলে মিয়ানমারে নিয়ে বন্দি করে
মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন চালায়। কৌশলে কয়েক ধাপে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করে মানবপাচার চক্ররা। মুক্তিপণ নিয়েও আরিফ হোসেনকে দেশে ফিরতে দেয়নি ওই চক্র।
চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে নেমেছে কালীগঞ্জ থানার ওসি আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে থানার সঙ্গীয় ফোর্স। অবশেষে ঘটনার সঙ্গে জড়িত এক রোহিঙ্গাসহ মানবপাচার চক্রের চার সদস্যকে কক্সবাজার থেকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে কালীগঞ্জ থানা পুলিশ। এছাড়া বন্দি আরিফকে উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
গ্রেফতারদের শনিবার দুপুরে গাজীপুর আদালতে পাঠানো হয়েছে। গ্রেফতাররা হলেন- কক্সবাজারের মোস্তাক আহমেদ (৫৪), বোরহান (২১), টেকনাফের তৈয়ব (২১) এবং উখিয়ায় বসবাস করা রোহিঙ্গা মো. উল্লাহ (৩৮)।
বন্দি আরিফ হোসেন কালীগঞ্জের চুয়ারিয়াখোলা এলাকার জয়নাল আবেদিনের ছেলে।
পুলিশ ও বন্দির স্বজনদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা গেছে, আরিফ হোসেন দুই বছর আগে মালয়েশিয়ায় কর্মরত থাকা অবস্থায় আত্মীয়ের মাধ্যমে তার পরিচয় হয় কক্সবাজারের রামুর পশ্চিম সিকদার পাড়ার কামাল উদ্দিনের ছেলে আব্দুল্লাহ আল মামুন (৩০) এবং পূর্ব কলাতলির মীর কাশেমের ছেলে মোস্তাক আহমেদসহ অজ্ঞাতনামা ৩-৪ জনের সঙ্গে। সেই সময় তারা বিদেশে লোক পাঠানোর ব্যবসা করে বলে জানায়।
২০২৩ সালে মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরে আসেন আরিফ হোসেন। এরপর তাকে ইতালি পাঠানোর প্রলোভন দেখায় মামুন ও মোস্তাক। একপর্যায়ে ছয় লাখ টাকায় ইতালি পাঠানোর জন্য ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তাদের সঙ্গে চুক্তি করেন তিনি। এরপর আবদুল্লাহ আল মামুনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১১ ডিসেম্বর ১ লাখ টাকা এবং ১৭ ডিসেম্বর আরও ১ লাখ টাকা পাঠানো হয়। পাশাপাশি নগদ আরও ৩ লাখ টাকা দেওয়া হয়।
এরপর তারা আরিফকে প্রথমে মিয়ানমারে নিয়ে যায় এবং পরে ইতালি পাঠানোর কথা বলে ১১ ডিসেম্বর বাড়ি থেকে বের করে। মিয়ানমারে নেওয়ার পর তারা আরিফকে বন্দি করে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করতে থাকে। পরবর্তীতে অপহরণকারীরা অজ্ঞাত মোবাইল নম্বর থেকে কল দিয়ে আরিফের মাধ্যমেই তার পরিবারকে জানায়, ১ লাখ টাকা পাঠালে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে। এরপর ১ জানুয়ারি মামুনের ইসলামী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ১ লাখ টাকা পাঠানো হয়। কিন্তু তারা আরিফকে মুক্তি দেয়নি।
এরপর আরও ৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে চক্রের সদস্যরা। টাকা না দিলে আরিফকে হত্যার হুমকি দেয় তারা। পরে ৫ জানুয়ারি তাদের দেওয়া একাধিক বিকাশ নম্বরে ৪ লাখ টাকা পাঠানো হয়। কিন্তু টাকা পাওয়ার পর অভিযুক্তরা তাদের সব মোবাইল ফোন বন্ধ করে রাখে।
একপর্যায়ে ১৮ জানুয়ারি আরিফের স্ত্রী সুলতানা বেগম সার্বিক বিষয় উল্লেখ করে প্রথমে কালীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।
এরপর ২৬ জানুয়ারি ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২’ এর একটি ধারায় প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে নিয়ে আটক করে মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগে কালীগঞ্জ থানায় মামলা করেন।
মামলার তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, এ ঘটনায় জড়িতরা আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য। তদন্তের একপর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় প্রথমে জানা গেছে, আসামি মোস্তাক কক্সবাজারে অবস্থান করছে। পরে কক্সবাজারে অভিযান চালিয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি মোস্তাককে গ্রেফতার করা হয়।
এরপর তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে শুক্রবার রাত পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে মানবপাচারকারী চক্রের আরও তিন সদস্যকে কক্সবাজার ও টেকনাফ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
কালীগঞ্জ থানার ওসি মো. আলাউদ্দিন বলেন, চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় এক রোহিঙ্গাসহ আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শনিবার তাদের আদালতে পাঠানো হয়েছে।
ওসি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার আসামিরা জানিয়েছে, ভিকটিম আরিফ বর্তমানে মিয়ানমারে আছে। তাকে উদ্ধারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।