Logo
Logo
×

সারাদেশ

চলন্ত বাসে ডাকাতি-শ্লীলতাহানি, ২ থানার ঠেলাঠেলিতে ৩ দিন পর মামলা

Icon

রাজশাহী ব্যুরো

প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:১০ এএম

চলন্ত বাসে ডাকাতি-শ্লীলতাহানি, ২ থানার ঠেলাঠেলিতে ৩ দিন পর মামলা

চলন্ত বাসে ডাকাতি ও নারী যাত্রীদের জিম্মি করে শ্লীলতাহানির ঘটনায় টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানায় মামলা হয়েছে। শুক্রবার ভোরে বাসের যাত্রী নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার চশবড়াইগ্রামের ওমর আলী বাদী হয়ে ডাকাতদলের অজ্ঞাতনামা ৮ থেকে ৯ জন সদস্যের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন।

তবে মামলায় বাসের চালক ও সুপারভাইজারকে আসামি করা হয়নি। মামলার এজাহারে বাসটিতে দুজন নারী যাত্রীকে শ্লীলতাহানি এবং সব যাত্রীর কাছ থেকে টাকা ও মালামাল লুটের অভিযোগ আনা হয়েছে।

মির্জাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশারফ হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

চাঞ্চল্যকর এ ডাকাতির ঘটনার মামলা কোথায় হবে-তা নিয়ে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর ও নাটোরের বড়াইগ্রাম থানা পুলিশের মধ্যে ঠেলাঠেলি চলছিল ঘটনার পর থেকে। অবশেষে তিন দিন পর ডাকাতির উৎসস্থল মির্জাপুর থানায় মামলাটি রুজু হলো।

তবে ভয়াবহ এই ঘটনা মহাসড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিয়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।

এদিকে মামলা হলেও শুক্রবার সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন তৈরির সময় পর্যন্ত ঘটনায় জড়িত কাউকে গ্রেফতারের খবর পাওয়া যায়নি।

মামলার এজাহারে যা আছে : এজাহারে বলা হয়েছে, যাত্রীবাহী বাসটি ১৭ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১১টার দিকে ইউনিক রোড রয়েলস্ পরিবহণের বাসটি (ময়মনসিংহ-ব-১১-০০৬১) ঢাকার গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে রাজশাহীর নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম যাওয়ার উদ্দেশে রওয়ানা হয়। এ সময় বাসটিতে ৩০ থেকে ৩৫ জন যাত্রী ছিল। রাত ১২টার দিকে হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলে সেখান থেকে আরও ১০ থেকে ১২ জন যাত্রী নিয়ে বাসটি পুনরায় রাজশাহীর উদ্দেশে রওয়ানা দেয়।

আনুমানিক রাত ১টার দিকে বাসটি গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর থানাধীন চন্দ্রা বাইপাসে পৌঁছলে চা-বিরতির জন্য থামে। সেখানে ১০ থেকে ১৫ মিনিট বিরতির পর আরও তিন থেকে চারজন নতুন যাত্রী নিয়ে রাজশাহীর উদ্দেশে রওয়ানা দেয় বাসটি। দেড়টার দিকে গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর থানাধীন হাইটেক সিটি পার্কসংলগ্ন খাড়াজোড়া ফ্লাইওভার ব্রিজ অতিক্রম করার ৫ থেকে ৬ মিনিট পর হঠাৎ বাসে ৮ থেকে ৯ জন যাত্রীবেশে থাকা ডাকাত একসঙ্গে দাঁড়িয়ে যায় এবং ধারালো চাকু ও চাপাতি দিয়ে প্রাণে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে সবাইকে চুপ থাকতে বলে।

এ সময় তাদের মধ্যে তিনজন অজ্ঞাতনামা ডাকাত গাড়িচালকের গলায় ধারালো চাকু ধরে টানাহেঁচড়া করে কিলঘুসি মেরে উঠিয়ে নিয়ে পেছনে উলটা করে রাখে। ডাকাতদের মধ্য থেকে একজন চালকের আসনে বসে বাসটি নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং বাসটি চালিয়ে টাঙ্গাইলের দিকে রওয়ানা হয়।

পরে মির্জাপুর উপজেলার সোহাগপাড়া সাকিনস্থ ফুটওভার ব্রিজের প্রায় ১০০ গজ পশ্চিম পাশে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে পৌঁছালে ডাকাতদলের ৬ থেকে ৭ জন গাড়িতে থাকা অন্য যাত্রীদের ধারালো চাকু ও চাপাতি দিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। তারা যাত্রীদের বলে, ‘তোদের সঙ্গে টাকা-পয়সাসহ যার যা কিছু আছে সব দিয়ে দে।’ এরপর যাত্রীদের কাছে থাকা টাকা, মোবাইল ফোন, স্বর্ণালংকার ও রুপাসহ সব মালামাল ছিনিয়ে নেয়। পরে ডাকাতদলের সদস্যরা মির্জাপুরের নাটিয়াপাড়া নাছির গ্লাসের সামনে থেকে ইউটার্ন নিয়ে ঢাকার দিকে রওয়ানা দেয়। তারা দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা গাজীপুরের কালিয়াকৈর, কোনাবাড়ীসহ গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় ঘোরায় এবং এ সময়ের মধ্যে যাত্রীদের ধারালো চাকু ও চাপাতি দিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। এ সময় দুজন নারী যাত্রীকে শ্লীলতাহানি করা হয়।

এজাহারে আরও বলা হয়, সব যাত্রীর টাকাসহ অন্যান্য মালামাল লুট করে রাত ৪টার দিকে ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানাধীন বাড়ইপাড়া এলাকার নন্দন পার্কের সামনে গাড়িটি টাঙ্গাইল অভিমুখী থামিয়ে চালককে ভয় দেখিয়ে বলে, ‘১০ কিলোমিটারের মধ্যে গাড়িটি কোথাও থামালে তোকে জানে মেরে ফেলব, আমরা তোদের গাড়ির পিছনে পিছনে আছি’ এই বলে ডাকাতদলের সদস্যরা মালামাল ও টাকা-পয়সাসহ গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত চলে যায়। পরে চালক গাড়ি নিয়ে চন্দ্রা মোড়ে গেলে গাড়িতে থাকা যাত্রীরা জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করে ঘটনার বিষয়ে পুলিশকে জানালে কিছুক্ষণের মধ্যে টহল পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়।

তখন গাড়িতে থাকা যাত্রীরা ডাকাতির বিষয়ে বিস্তারিত জানালে কালিয়াকৈর থানাধীন চন্দ্রা এলাকার টহলরত পুলিশ মির্জাপুর থানায় যাওয়ার পরামর্শ দিলে চালক গাড়ি নিয়ে মির্জাপুর বাসস্ট্যান্ডে যায়। তখন কয়েকজন যাত্রী ও গাড়ির সুপারভাইজার মির্জাপুর থানায় গিয়ে ডিউটি অফিসারকে বিষয়টি মৌখিকভাবে অবগত করে পুনরায় রাজশাহীর উদ্দেশে রওয়ানা হয়। নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম থানা মোড়ে গেলে গাড়ি থেকে তিন থেকে চারজন যাত্রী নেমে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় গাড়ির চালক, হেলপার ও সুপারভাইজার ডাকাতির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গাড়িটি আটক করে।

বিষয়টি বড়াইগ্রাম থানা পুলিশকে জানানো হয়। খবর পেয়ে বড়াইগ্রাম থানা পুলিশ সেখানে গিয়ে গাড়ির চালক, হেলপার ও সুপারভাইজারকে পুলিশি হেফাজতে নেয়। পরে বড়াইগ্রাম থানা পুলিশ গাড়ির চালক, হেলপার ও সুপারভাইজারকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় আদালতে প্রেরণ করে। ডাকাতদের বয়স অনুমান ২৫ থেকে ৩৮ বছরের মধ্যে।

মামলার বাদী ওমর আলী সাংবাদিকদের বলেন, বাসে থাকা সব যাত্রীর কাছ থেকে টাকা, মোবাইল ও মালামাল লুট করা হয়েছে। বাসটিতে ৭ থেকে ৮ জন নারী যাত্রী ছিল। আসলে সেদিন রাতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। তবে নারীদের সঙ্গে খুব বাজে আচরণ করা হয়েছে। ধর্ষণ না করলেও দুজনের সঙ্গে খুব বাজেভাবে শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে। টাকা-গহনা সব দেওয়ার পরও তাদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে ডাকাতরা। তারা থানা পুলিশকে এসব বলেছেন।

তিনি আরও বলেন, এ ঘটনায় বড়াইগ্রাম থানায় মামলা করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু ঘটনাস্থল বড়াইড়গ্রাম এলাকা না হওয়ায় সেখানে মামলা নেয়নি। তাই মির্জাপুর থানায় মামলা করেছি। কারণ আমাদের অনেক টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমরা চাই পুলিশ ডাকাতদের খুঁজে বের করবে এবং আইনের মুখোমুখি করবে। আমরা তাদের শাস্তি চাই।

এজাহার পড়ে শোনানো হয়নি বাদীকে : এজাহারে বাসের সুপারভাইজারের কাছ থেকে ডাকাতরা ৩০ হাজার টাকা ও দুটি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মামলার বাদী ওমর আলী। তিনি বলেছেন- সুপারভাইজারের কাছ থেকে ডাকাতরা সব টাকা-পয়সা নিয়ে নিলে তারা যমুনা সেতুর টোল কীভাবে দিলেন? বাসে তেল ভরলেন কীভাবে? তারা হোটেলে খেলেন কীভাবে?’ এজাহার আমাকে পড়ে শোনানো হয়নি। পুলিশ এজাহারে স্বাক্ষর দিতে বলেছে। তাই স্বাক্ষর করেছি।

১৫ যাত্রীর জবানবন্দি : এদিকে বৃহস্পতিবার রাতে মির্জাপুর থানা পুলিশের পাঁচ সদস্যের একটি দল নাটোরের বড়াইগ্রাম থানায় গিয়ে ভয়াবহ ডাকাতির শিকার ১৫ জন যাত্রীর জবানবন্দি নিয়েছে। বড়াইগ্রাম থানা পুলিশ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

ভুক্তভোগী যাত্রীদের কাউকে থানায় ডেকে নিয়ে আবার দূরে অবস্থানকারী যাত্রীদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন মির্জাপুর থানা পুলিশের ওসি তদন্ত মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন। তাদের সহযোগিতা করেন বড়াইগ্রাম থানা পুলিশ। পুলিশকে দেওয়া জবানবন্দিতে ভুক্তভোগীরা ওই রাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন। ডাকাতরা লুটপাটের সময় দুই নারী যাত্রীর শ্লীলতাহানি করেছে বলে তারা পুলিশকে জানিয়েছেন। নারী যাত্রীরাও একই কথা জানিয়েছেন মির্জাপুর থানা পুলিশকে। তবে ধর্ষণের বিষয়ে তারা কিছু বলেননি।

যে কারণে দেরিতে মামলা : যেদিন ঘটনা ঘটেছে, তার পরদিন সকালে যাত্রীরা অভিযোগ করলেও মামলা নেয়নি নাটোরের বড়াইগ্রাম থানা পুলিশ। সীমানা জটিলতার কথা বলে তারা ঠেলে দিয়েছিল বাসটির চলার রুটে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার দিকে। আবার মির্জাপুর থানা থেকে বলা হয়েছিল যে, এই ঘটনা মির্জাপুর থানার সীমান্তে ঘটেনি। যদিও যাত্রীদের অভিযোগের ভিত্তিতে বড়াইগ্রাম থানা পুলিশ বাসের চালক, চালকের সহকারী ও সুপারভাইজারকে আটক করেছিল। আটকদের আদালতে সোপর্দ করলেও সেদিনই সন্ধ্যা নাগাদ তারা জামিনে মুক্তি পেয়ে যান। দুই থানা পুলিশের দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টার কারণে মামলা দায়েরে বিলম্ব হচ্ছিল।

কিন্তু সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হওয়ায় ঘটনাটি দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। বাসটির চালকসহ আটকদের জামিনে মুক্তি এবং সময়মতো মামলা না নেওয়া-এ নিয়েও গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুলিশ, প্রশাসন তথা সরকারের সমালোচনা চলছে। অনেকেই চলাচলের ক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এমন প্রেক্ষাপটে শেষ পর্যন্ত মামলা নিয়েছে পুলিশ।

টাঙ্গাইল পুলিশ সুপারের ব্রিফিং : বিষয়টি নিয়ে শুক্রবার বিকালে মির্জাপুর থানার ওসির কার্যালয়ে ব্রিফিং করেন টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ঘটনাটি ঢাকা, গাজীপুর ও টাঙ্গাইল-তিন জেলায় সম্পৃক্ত। ভুক্তভোগীদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে টাঙ্গাইলের পুলিশ চ্যালেঞ্জ হিসাবে মামলাটি নিয়েছে। ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করা হবে। পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের একাধিক দল বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে ইতোমধ্যে অনেকদূর এগিয়েছে।

বড়াইগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রত্যাহার : যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি ও নারী যাত্রীকে শ্লীলতাহানির ঘটনায় অভিযোগ না নেওয়াসহ দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে বড়াইগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলামকে পুলিশ লাইনে প্রত্যাহার করা হয়েছে। শুক্রবার বিকালে তাকে পুলিশ লাইনসে প্রত্যাহার করেন রাজশাহী রেঞ্জ ডিআইজি মোহাম্মদ শাহজাহান।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ :  চলন্ত বাসে ডাকাতি ও নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানির ঘটনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে। শুক্রবার বিকালে পরিবহণ মার্কেটের আমতলা চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি শুরু হয়। ক্যাম্পাসের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাডেমিক ভবনসংলগ্ন রাস্তাসহ কয়েকটি গুরুত্ব সড়ক প্রদক্ষিণ করে প্যারিস রোডে গিয়ে মিছিলটি শেষ হয়। পরে সেখানে একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ হয়। ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ ব্যানারে এ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।

সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি রাকিব হোসেন, ছাত্র গণমঞ্চের আহ্বায়ক নাসিম সরকার, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের আহ্বায়ক ফুয়াদ রাতুল, দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী শ্রেয়সী, বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী গোপাল রায় প্রমুখ বক্তব্য দেন। সমাবেশটি সঞ্চালনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী রাবেয়া মুহিব।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নাটোর, টাঙ্গাইল, বড়াইগ্রাম ও রাবি প্রতিনিধি

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম