কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মর্যাদা ফিরে পেয়ে এমএম কলেজে জনতার ঢল

যশোর ব্যুরো
প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:১৯ এএম

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরই যশোরের সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজে স্থাপিত হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। প্রতি বছর সেই শহীদ মিনারেই শ্রদ্ধা জানাতো যশোরবাসী। কিন্তু আওয়ামী লীগ আমলে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ শহরের শহীদ মসিয়ূর রহমান সড়কের পাশে নতুন শহীদ মিনার নির্মাণ করে, যার নাম দেওয়া হয় ‘কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার’। এরপর থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহীদ দিবসে এমএম কলেজে তুলনামূলক কম ভিড় হতো।
দীর্ঘ ৬ বছর পর একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে এমএম কলেজে অবস্থিত শহীদ
মিনার ফিরে পেয়েছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের স্বীকৃতি। এর জেরে সেখানে জনতার ঢল নেমেছে।
দিবসটির প্রথম প্রহর বৃহস্পতিবার রাত ১২টা ১ মিনিটে জেলা প্রশাসনের পক্ষে
জেলা প্রশাসক আজহারুল ইসলাম শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার নূর
ই আলম সিদ্দিকীসহ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, যশোর শিক্ষাবোর্ড, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন,
জেলা বিএনপিসহ বিভিন্ন সামাজিক, রাজনীতিক, সাংবাদিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতারা
শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এদিন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার
মানুষ সমবেত হন এমএম কলেজ প্রাঙ্গণে।
কলেজ ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, শোরের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়, যেটি এমএম কলেজ নামেই পরিচিত। ১৯৪১ সালে
‘যশোর কলেজ’ নামে প্রতিষ্ঠিত এবং ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ হয় ‘মাইকেল মধুসূদন
কলেজ’। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি সরকারি হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর প্রতি বছর
একুশে ফেব্রুয়ারি এমএম কলেজে স্থাপিত শহীদ মিনারে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সর্বস্তরের
মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে আসছিলেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যশোর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নিয়ে টানাপোড়েন শুরু
হয়। ২০১৮ সালে দুই কোটি টাকা ব্যয়ে পৌরসভার তৎকালীন মেয়র জহিরুল ইসলাম চাকলাদার রেন্টু
শহরের শহীদ মসিয়ূর রহমান সড়কের পাশে নতুন একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। এর নাম দেন
‘কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার’। অথচ সেখানে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই।
পৌরসভার মেয়র ও তৎকালীন প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় সে সময় কেউ খুশি হয়নি।
কিন্তু তাদের ভয়ে কেউ কার্যকর প্রতিবাদও করতে পারেনি। বিএনপি ও কয়েকটি বাম দল ছাড়া
অন্যরা নতুন শহীদ মিনারে যেতে বাধ্য হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুরনো কেন্দ্রীয়
শহীদ মিনারের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে।
এমন প্রেক্ষাপটে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ‘আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবস উদযাপন প্রস্তুতি কমিটির’ সভা অনুষ্ঠিত হয়। জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল
ইসলামের সভাপতিত্বে সে সভায় সিদ্ধান্ত হয়, যশোরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বলতে এমএম কলেজের
শহীদ মিনারকে বোঝাবে। এই শহীদ মিনারেই এবার ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।
একইসঙ্গে পৌরসভার অর্থায়নে নির্মিত শহীন মিনারটি সাদা কাপড়ে ঘিরে দেওয়ার সিদ্ধান্ত
নেওয়া হয়।
দীর্ঘ ছয় বছর পর এমএম কলেজে অবস্থিত শহীদ মিনার কেন্দ্রীয় স্বীকৃতি ফিরে
পাওয়াতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে কলেজটির শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও যশোরবাসী। তারা বলছেন,
শহরের শহীদ মসিয়ূর রহমান সড়কের পাশে অপ্রশস্ত একটি স্থানে শহীদ মিনার নির্মাণ হওয়ায়
মানুষের ঢলে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। এখন বৃহৎ ক্যাম্পাসে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ফিরে
আসায় স্বত্বিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারছেন।
একুশের প্রথম প্রহরে সরেজমিনে এম এম কলেজে দেখা গেছে, ভাষা শহীদদের প্রতি
গভীর শ্রদ্ধা জানাতে হাতে ফুল, কালো ব্যাজ ধারণ করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা
জানাচ্ছে আপামর জনতা। একুশের প্রথম প্রহর থেকে এ শ্রদ্ধা নিবেদন শুরু হয়। হাজারো মানুষকে
শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনার অভিমুখে যেতে দেখা গেছে। জেলা স্কুল মোড় থেকে এমএম কলেজের
দক্ষিণগেট পর্যন্ত দীর্ঘ সারি। সেখান থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত পুরো এলাকা
লোকে লোকারণ্য।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয়
সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ‘শহীদ মসিয়ূর রহমান সড়কে নির্মিত শহীদ মিনারে
আমরা কোনো দিনই যায়নি। এমএম কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থিত শহীদ মিনারকেই আমরা কেন্দ্রীয়
শহীদ মিনার মানি। আমাদের দল বরাবরই দাবি করে আসছিল, এ শহীদ মিনারেই যেন শ্রদ্ধার্ঘ্য
নিবেদন করা হয়।’