Logo
Logo
×

সারাদেশ

কুয়েট ক্যাম্পাস বন্ধ, ভিসি-প্রোভিসির পদত্যাগ দাবিতে অনড় শিক্ষার্থীরা

Icon

খুলনা ব্যুরো

প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৫৯ পিএম

কুয়েট ক্যাম্পাস বন্ধ, ভিসি-প্রোভিসির পদত্যাগ দাবিতে অনড় শিক্ষার্থীরা

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) একাডেমিক কার্যক্রম ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে কুয়েট শিক্ষার্থীদের ওপর বহিরাগতদের হামলার ঘটনা তদন্তে গঠন করা হয়েছে চার সদস্যের কমিটি। নিষিদ্ধ করা হয়েছে ছাত্র রাজনীতি। এর সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রমাণ মিললে শিক্ষার্থীদের আজীবন বহিষ্কার ও ছাত্রত্ব বাতিল করা হবে। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না।

মঙ্গলবার কুয়েটে সহিংসতার ঘটনায় বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের ৯৩তম সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের পদত্যাগ দাবিতে অনড়।

তারা এদিন সকাল থেকে একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেন। এতে পুরো ক্যাম্পাস থমথমে হয়ে ওঠে। পরে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে ৭ ঘণ্টা ধরে উপাচার্য মুহাম্মদ মাছুদকে অবরুদ্ধ করে রাখেন তারা।

এদিকে মঙ্গলবার হাফ হাতা শার্ট গায়ে ও মুখে গামছা জড়িয়ে রাম-দা হাতে হামলায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিটির পরিচয় মিলেছে। তিনি যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান বলে স্থানীয়রা নিশ্চিত করেছেন। তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। পুলিশ সহিংসতার ঘটনায় ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে। তবে তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি।

এদিকে কুয়েটে হামলার ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল ও যশোরে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন হয়েছে।

জানা গেছে, মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে শিক্ষার্থীদের ওপর বহিরাগতদের হামলার ঘটনায় উপাচার্যের পদত্যাগসহ প্রথমে পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেন। পরে তারা এরসঙ্গে আরেকটি দাবি যোগ করেন। বুধবার সকাল থেকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে জড়ো হতে থাকেন। দাবি মেনে নেওয়ার জন্য দুপুর ১টা পর্যন্ত বেঁধে দেওয়া সময় পার হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলোতে তালা ঝুলিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, তাদের ছয় দাবি পরিপূর্ণভাবে মেনে না নিলে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।

আন্দোলনরত এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করে বলেন, দুপুর ১টা পর্যন্ত আমাদের আলটিমেটাম ছিল। প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আমাদের সব দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়া হয়নি। তাই আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা মিলে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রশাসনিক ভবন, বিভিন্ন একাডেমিক ভবন ও বিভাগে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছি। তারা পদত্যাগ না করা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ছাড়বে না।

উপাচার্য ৭ ঘণ্টা অবরুদ্ধ : সকাল ৯টা থেকে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রের সামনে অবস্থান নেন। তখন এই চিকিৎসাকেন্দ্রের দোতলায় চিকিৎসাধীন ছিলেন উপাচার্য মুহাম্মদ মাছুদ। মঙ্গলবার রাতে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি সেখানে যান। এরপর বুধবার ৪টায় সেখান থেকে তিনি নিজের বাসভবনে চলে যান।

সিন্ডিকেট সভায় সিদ্ধান্ত : এদিন বেলা সাড়ে ১১টায় অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের ৯৮তম (জরুরি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন উপাচার্য ড. মুহাম্মদ মাছুদ। এতে পাঁচটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ও প্রকৌশলী মো. আনিছুর রহমান ভূঞা স্বাক্ষরিত সিন্ডিকেট সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, কুয়েটে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট ঘোষিত রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের আদেশটি বহাল থাকবে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৩-এর ধারা ৪৪(৫) অনুযায়ী সব শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে সব ধরনের রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ আইন অমান্যকারীর বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধান অনুযায়ী চাকরিচ্যুত করাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এছাড়া রাজনীতির সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তদন্ত সাপেক্ষে আজীবন বহিষ্কার ও ছাত্রত্ব বাতিল করা হবে।

মঙ্গলবারের হামলার ঘটনায় জড়িত বহিরাগতদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মামলাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। একই সঙ্গে সরাসরি জড়িত শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হবে। প্রকৃত দোষী শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করাসহ পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করবে।

কমিটির সভাপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এমএমএ হাসেম, সদস্য শহিদ স্মৃতি হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ আবু ইউসুফ, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু জাকির মোর্শেদ ও সদস্য সচিব সহকারী পরিচালক (ছাত্রকল্যাণ) শাহ মুহাম্মদ আজমত উল্লাহ। খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে ও ক্যাম্পাসসংলগ্ন এলাকায় সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসন কর্তৃক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ ঘটনায় আহত সব শিক্ষার্থীর চিকিৎসা ব্যয়ভার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহন করবে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সব প্রকার একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

উপাচার্যসহ তিনজনের পদত্যাগ দাবিতে অনড় শিক্ষার্থীরা : শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ছাত্রবিষয়ক পরিচালকের পদত্যাগসহ ছয় দাবি পূরণে আলটিমেটাম দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। দাবিগুলো হলো-১. পরিকল্পিতভাবে হামলার ঘটনায় জড়িত শিক্ষার্থী এবং প্রশ্রয়দাতা শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে কুয়েট প্রশাসনের পক্ষ থেকে হত্যার চেষ্টা ও নাশকতার মামলা করতে হবে এবং জড়িত সবাইকে বহিষ্কার এবং ছাত্রত্ব বাতিল করতে হবে। ২. বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী কুয়েটের ভেতরে ও বাইরে, কোনো প্রকার রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকতে পারবেন না-এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে আজীবন বহিষ্কার এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ছাত্রত্ব বাতিল করতে হবে। ৩. ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কুয়েট শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য ক্যাম্পাসের বাইরে পর্যাপ্তসংখ্যক সামরিক বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করতে হবে। ৪. হামলায় আহত সবার চিকিৎসাসংক্রান্ত ব্যয়ভার কুয়েট প্রশাসন থেকে বহন করতে হবে। ৫. হামলা ঠেকাতে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের পদত্যাগ করতে হবে। মঙ্গলবারের এই দাবির সঙ্গে বুধবার তারা আরও একটি দাবি তোলে। সেটি হচ্ছে-৬. ঘটনার দ্বায় স্বীকার করে কুয়েট প্রশাসনকে বিবৃতি দিতে হবে।

ছাত্রদলের সংবাদ সম্মেলন : কুয়েটে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে ছাত্রদল। বুধবার দুপুরে খুলনা প্রেস ক্লাবের লিয়াকত আলী মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে কুয়েট ছাত্রদল। এতে লিখিত বক্তব্য দেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহসভাপতি আবু আফসান মো. ইয়াহিয়া।

তিনি বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় ‘সাধারণ শিক্ষার্থীর’ ব্যানারের পেছনে লুকানো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির ধারক-বাহক ইসলামী ছাত্রশিবিরের গুপ্ত কর্মী এবং ক্যাম্পাসে রয়ে যাওয়া ফ্যাসিবাদী নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীরা জড়িত। যার ফলশ্রুতিতে পরিকল্পিতভাবে এমন একটি মব তৈরি করা হয়েছে।

ইয়াহিয়া আরও বলেন, ফরম পূরণ কার্যক্রম শুরু না হলেও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শে উজ্জীবিত শিক্ষার্থী হিসাবে পরিচিতসহ আরও কিছু শিক্ষার্থীকে হেনস্তা করার উদ্দেশ্যে চিহ্নিত ও তালিকাভুক্ত শিক্ষার্থীরা ‘সাধারণ শিক্ষার্থীর’ ব্যানারে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে।

তিনি বলেন, ছাত্রদল কুয়েট ক্যাম্পাসে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন না করলেও এসব গুপ্ত ষড়যন্ত্রকারীদের ইন্ধনে সাধারণ শিক্ষার্থী পরিচয়ে উক্ত মব মিছিলটির পূর্বে ছাত্রদলের রাজনীতি নিষিদ্ধ চেয়ে ক্যাম্পাসে বিশাল ব্যানার টানানো হয় এবং মিছিল থেকে বিনা উসকানিতে ছাত্রদলের উপরোক্ত সমর্থকদের ওপরে হামলা চালানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- ছাত্রদলের সহসভাপতি হাবিবুল বাশার, সাফি ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাহেদ হাসান, হাসানুর রহমান, শাহাদাত হোসেন, সোহেল রানা, নুরুজ্জামান চন্দন, কুয়েট ছাত্রদল সমর্থক রাহুল জাবেদ, ইফান জমাদ্দার প্রমুখ।

অস্ত্র হাতে থাকা যুবদল নেতা বহিষ্কার : বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের সময় ধারালো অস্ত্র হাতে অবস্থান নেওয়া খুলনার দৌলতপুর থানা যুবদলের সহসভাপতি মাহবুবুর রহমানকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে কেন্দ্রীয় যুবদলের দপ্তর সম্পাদক নুরুল ইসলাম সোহেল স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে দৌলতপুর থানা যুবদলের সহসভাপতি মাহবুবুর রহমানকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কৃত নেতাদের কোনো অপকর্মের দায়-দায়িত্ব দল নেবে না। যুবদলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের তার সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক না রাখার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

গ্রেফতার পাঁচ : খানজাহান আলী থানার ওসি কবির হোসেন বলেন, কুয়েটে ছাত্রদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। মারামারির ঘটনায় জড়িত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মঙ্গলবার ছাত্রদল ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত অর্ধশত শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তাদের অধিকাংশের শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে। সংঘর্ষের সময় ধারালো অস্ত্র হাতে বেশ কয়েকজনকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করতে দেখা যায়।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম