Logo
Logo
×

সারাদেশ

শহিদ বিপ্লবের মেয়ে আমিনা

বাবা বলেছিল আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসবে

Icon

নওগাঁ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:৪৯ পিএম

বাবা বলেছিল আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসবে

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ঢাকার বাইপাইলে নওগাঁর বিপ্লব মণ্ডল (৩৩) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। নিহত বিপ্লব মণ্ডল নওগাঁ সদর উপজেলার শিমুলিয়া মণ্ডলপাড়া গ্রামের লুৎফর মণ্ডলের ছেলে। শহিদ বিপ্লব ঢাকার বাইপাইল এলাকায় একটি সেলুনে কাজ করতেন। ৫ আগস্ট সেলুনে যাওয়ার সময় মেয়েকে বলেছিলেন- আসার সময় তোমার চকলেট নিয়ে আসব। তিনি ফিরেছেন লাশ হয়ে।  

শহিদ বিপ্লবের বাবা লুৎফর মণ্ডল বলেন, গত ৪ আগস্ট সকাল ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে বিপ্লব তার ছোট ভাই ফিরোজকে ফোনে না পেয়ে কল দেয় আমাকে। বলে- আব্বা তুমি গ্রামের বাহিরে কাজ করতে যেও না। ছোট ভাইকেও কাজে যেতে দিও না। তোমরা সাবধানে থেকো। আরও বলে, কেউ ডাকলে যাবে না। দেশের অবস্থা ভালো না। ঢাকায় চরম গণ্ডগোল হচ্ছে। আমার জন্য চিন্তা করো না। বাবা তুমি মা ও ছোট ভাইকে দেখে রেখ। তাদের যেন কিছু না হয়। এগুলো ছিল তার শেষ কথা।

তিনি আরও বলেন, এরপর ৫ আগস্ট সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনি ঢাকায় ব্যাপক গণ্ডগোল হচ্ছে। কিছু ভালো লাগছে না। জোহরের নামাজের আগে ফোন দিলাম। ফোন বন্ধ। তখন বউ-মাকে ফোন দিলাম তখন বউ মা বলল; মনে হয় আপনার ছেলে দোকানে গেছে। বউ মা-কে বললাম বিপ্লব কী আন্দোলনে গেছে। উত্তরে বলে; সব কথা তো আমাকে বলে না বাবা। চিন্তা আরও বেড়ে গেল। তখন জোহরের নামাজের সময়। বিপ্লবের মাকে বললাম ভাত দাও। ভাত খেয়ে নামাজে যাব। তখন মনটা ছটফট করছে। ভাত না খেয়ে বড় মেয়ে মিমিকে ফোন দিলাম। মিমি বলল- আমি ভাইয়ের বাসাতে গিয়ে তোমারে বলছি। বিপ্লবের মাকে বললাম আগে ছেলের সঙ্গে কথা বলব- তারপর ভাত খাব। অনেকক্ষণ পর মিমি বলল- আব্বা তোমার ছেলের ফোন বন্ধ। পাওয়া যাচ্ছে না। তার বন্ধুরা বলল- বিপ্লব ভাইকে গুলি করেছে খুনি হাসিনা।

তিনি আরও বলেন, তখন আমি মিমিকে বললাম তোর ভাই এর লাশের খোঁজ কর মা। তখন বেলা ৫টা বাজে। মেডিকেলে খোঁজ কর লাশ পাওয়া যাবে। না কি খুনি হাসিনা হাজার হাজার লাশ একত্র করে গণকবর দিয়েছে। তখন সবাই খোঁজাখুঁজি করেও বিপ্লবের লাশের খবর কেউ দিতে পারেনি। পরদিন ৬ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে শেখ ফজিলাতুননেছা মেডিকেলে বিপ্লবের লাশের খোঁজ পান কিন্তু জীবিত নয় মৃত। কথা বলতে বলতে হাউ-মাউ করে কাঁদতে থাকে লুৎফর মণ্ডল। তবে হাসপাতাল থেকে লাশ আনা মুশকিল ছিল। তারা লাশ দিতে চাচ্ছিল না। হাসপাতালের লোকজন বলেছে লাশের কোনো কাগজ দেবে না। জোর করে মোবাইলে ছবি তোলা হয়েছিল। অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া গেল কিন্তু ভাড়া ১৫ হাজার টাকা। হাসপাতাল দিল মাত্র ৫ হাজার টাকা।

শহিদ বিপ্লবের বাবা বলেন, গরিব কৃষি শ্রমিকের পক্ষে লাশ আনার জন্য আরও ১০ হাজার টাকা কিভাবে দিবে তার চিন্তায় শেষ। যাই হোক অনেক কষ্ট করে লাশ আসরের নামাজের ১৫-২০ মিনিট আগে বাড়িতে নিয়ে এসে দাফন করা হয়। পরে অনেক কষ্ট করে টাকা পরিশোধ করেছি। বলে আর হাউ মাউ করে কাঁদে।

ওই গ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবিএম এনামুল হক বকুল বলেন, বিপ্লবের পরিবার অসহায়। তার বাবা আগে ভ্যান চালাত। এখন অন্যের জমি ও বাড়িতে কাজ করে কোনো রকম সংসার চালায়। যে ছেলে মারা গেছে তার আয় দিয়ে সংসার চলতো লুৎফরের। ছেলে মারা যাবার পর সে আয় বন্ধ হয়ে গেছে। পরিবারের জন্য সরকারের পক্ষে যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি চাকরির ব্যবস্থা ও শহিদ বিপ্লবের ৯ বছরের শিশুর জন্য পড়ালেখার খরচ চালানোর দাবি তার। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা তার পরিবার পেয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বিশ্বের কোথাও নজির নাই মাত্র ৩৬ দিনে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। তাই এই খুনি হাসিনাসহ দলের সবার বিচার হওয়া দরকার।

শহিদ বিপ্লব মণ্ডলের মা বিলকিস বেগম বলেন, আমার চার ছেলে-মেয়ে। এর মধ্যে বিপ্লব ২য়। সবার বড় মিমি, এরপর ফিরোজ আর সবার ছোট বৃষ্টি। বিপ্লবের জন্ম ১৯৯১ সালের ৮ জুলাই। ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। সংসারের অভাবের কারণে লেখাপড়া করেনি। বাড়ির পাশে মাদারমোল্লায় সেলুনের কাজ করত। তার উপার্জনের টাকা দিয়ে চলতো সংসার। আজ থেকে ১০ বছর আগে একই গ্রামের আরিফার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ফুটফুটে একটা কন্যাসন্তান আসে তার ঘরে। আস্তে আস্তে সংসারের অভাব বেড়ে যাওয়ায় সেলুনের কাজ করতে ঢাকায় যায় ৪ বছর আগে। সবাই থাকতো। গত ৪ আগস্ট রাতে বিপ্লব ফোন দেয় তার বাবাকে। অল্প কথা বলে আমার সঙ্গে। বলল- আব্বার বয়স অনেক হয়েছে। দেখে রেখ মা।

তিনি আরও বলেন, খুনি হাসিনা আমার ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। খুনি হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে আমরা সবাই ঘৃণা করি। কারণ এই দল শত শত মানুষকে গুলি করে শেষ করে দিয়েছে। অনেকের লাশ গুম করে ফেলেছে। আমরা এই খুনি হাসিনার বিচারের দাবি করছি।

শহিদ বিপ্লবের স্ত্রী আরিফা বেগম বলেন, বাড়িতে বসে সময় না কাটায় বিপ্লবের সেলুনের পাশাপাশি তিনি গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। আমি ভোরে কাজে যাই আর সে সকাল ১০টায় দোকানে যায়। ঘটনার দিন আমার অফিস খোলা ছিল। আমি বাসায় থাকতেই বড় আপা মিমিকে ফোন দিয়ে বলে আপা আমার বাসায় আস আমিনা (বিপ্লবের মেয়ে) একা থাকবে। সে প্রতিদিন দোকান বন্ধ রেখে আন্দোলনে যেত- এটা আমি পরে জানতে পেরেছি। তার বন্ধুরা দুপুরে বাসায় এসে বলে বিপ্লবকে গুলি করে মেরে ফেলেছে খুনি হাসিনা।

তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত ৯ লাখ টাকার মতো সাহায্য পেয়েছি। তবে আমার মেয়ে ছোট। সরকারের পক্ষ থেকে যদি আমার মেয়েকে লেখাপড়া করাত। তাহলে অনেক ভালো হতো। মেয়েকে নিয়ে অনেক কষ্টে আছি।

শহিদ বিপ্লবের ৯ বছরের মেয়ে আমিনা বলে- বাবা সকালে দোকানে যাওয়ার সময় বলেছিল আমার জন্য দুপুরে চকলেট নিয়ে আসবে। আর দুপুরে আমরা সবাই এক সঙ্গে ভাতে খাবে। বাবা আর ফিরে আসল না।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্র প্রতিনিধি নওগাঁ সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের অনার্স ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী রতন হাসান বলেন, ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মাহিন সরকারসহ ২১ জন এসেছিল নওগাঁয়। তারা বিপ্লব ভাইয়ের কবর জিয়ারত করেছেন। আর নগদ কিছু অর্থ সহায়তা দিয়েছে। জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকার চেক প্রদান করা হয়েছে। জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম রাজশাহী শিল্পকলা একাডেমিতে এ টাকা প্রদান করেন।

নওগাঁর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে জুলাই-আগস্টে নওগাঁর ৯ জন শহিদ হয়েছেন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম