এক সময় জাহাজ চলত এখন ফসলের মাঠ- ঠাকুরগাঁওয়ে খোঁজ মিলল এমন ১৩ নদীর

এটিএম সামসুজ্জোহা, ঠাকুরগাঁও
প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭:৪৮ পিএম

জনশ্রুতি আছে- এক সময় জাহাজ চলত যে নদীতে, সেই নদী এখন ফসলের মাঠ। ঠাকুরগাঁওয়ের বুক চিরে বয়ে যাওয়া ভক্তি নদের এখন এমনই দশা। শুধু ভক্তি নয়, গত ৫০ বছরে জেলার অন্তত ১৩ নদ-নদী কালের পরিক্রমায় মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে।
সম্প্রতি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জেলার নদ-নদীর তালিকা অনুসন্ধান করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। বিলীন হয়ে যাওয়া খোঁজ মেলে ১৩টি নদীর।
ঠাকুরগাঁও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. গোলাম যাকারিয়া জানান, বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের চিহ্নিত স্থানীয় নদীর সংখ্যা মাত্র ১৪টি। নতুন করে যুক্ত হলো আরও ১৩টি। এসব নদী দখলমুক্ত ও খননের প্রস্তাব পাঠানো হবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে।
পাউবো সূত্রে জানা যায়, হারানো নদ-নদীর মধ্যে রয়েছে- রশিয়া, হাতুড়ি, জলই, পুনর্ভবা, মরা গোগরা, চাড়াল বান্দ, নহনা, আমান-ধামান, কাহালাই, বাগমারা, সারডুবি, মরাটাঙ্গন ও ভক্তি।
মঙ্গলবার ও বুধবার সরেজমিন দেখা যায়, বেশির ভাগ নদী শুকিয়ে গেছে। সেগুলো এখন ফসলের মাঠ। কোনো কোনো নদীর ক্ষীণ স্রোতোধারা জানান দিচ্ছে- এক সময় এখানে নদী ছিল।
স্থানীয়রা জানান, এক সময় এসব নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন নদী শুকিয়ে যাওয়ায় তাদের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্দশা।
সদর উপজেলার ভেলাজান এলাকার স্কুলশিক্ষক রফিকুল ইসলাম (৬৫) ভক্তি নদের তীরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ছোটবেলায় বাবার মুখে শুনেছি- এই নদে (ভক্তি) বড় বড় লঞ্চ চলত। জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। এখন শুধু স্মৃতি হয়ে আছে।
পাশের এলাকা শুখানপুকুরী ও বালিয়া ইউনিয়নে যার উৎপত্তিস্থল, সেই ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সারডুবি নদ আজ মৃতপ্রায়।
পাউবোর সদর উপজেলার কার্য সহকারী শফিউজ্জামান জানান, সারডুবি নদের ৭০ শতাংশ জমিতে এখন চাষাবাদ হয়, বাকি ৩০ শতাংশ ছোট ছোট খালে পরিণত হয়েছে।
নদীপারের বাসিন্দা মরিয়ম বেগম (৬০) বলেন, আগে এই নদীর পানি দিয়ে আমরা রান্না করতাম, কাপড় ধুতাম। এখন নদীটি দখল হয়ে গেছে। এলাকার প্রভাবশালীরা এই নদীতে ফসল ফলাচ্ছেন।
পীরগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত কাহালাই নদ প্রায় পুরোটাই শুকিয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পীরগঞ্জের কার্য-সহকারী শারাফাত হোসেন জানান, এ নদের ৭৫ শতাংশেই এখন চাষাবাদ হচ্ছে।
কৃষক হামিদ (৫০) বলেন, আগে এই নদে নৌকা চলত। এখন শুধু স্মৃতি রয়ে গেছে।
একই উপজেলার হাজিপুর ইউনিয়নে অবস্থিত জলই নদ বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দা জমিলা খাতুন (৬০) বলেন, আগে এই নদের ধারে অনেক গাছপালা ছিল। ছায়া হতো। এখন নদী শুকিয়ে যাওয়ায় সব গাছপালাও মরে গেছে। গ্রীষ্ম মৌসুমি তাপপ্রবাহে টিকে থাকা যায় না।
জেলার পরিবেশবাদী সংগঠন সৃজনের সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, ভুল নদী শাসন, দখল ও দূষণের কারণে এসব নদী বিলীন হয়েছে। অনুসন্ধান করলে এ সংখ্যা আরও বাড়বে।
ঠাকুরগাঁওয়ের শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক অধ্যাপক মনতোষ কুমার দে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে নাব্য হারাতে হারাতে নদীগুলো সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। আর এ সুযোগে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকেই বিদায় নিয়েছে অনেক নদ-নদী।
ঠাকুরগাঁও ভূমি সেটেলমেন্ট সহকারী কর্মকর্তা আবু তালেব বলেন, সিএস, এসএ এবং আরএস রেকর্ডে নদীগুলোর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ময়দুল ইসলাম রনি বলেন, দখল হওয়া নদীগুলো উদ্ধার করা সহজ নয়।
তিনি জানান, বিভিন্ন সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। ফলে বেশির ভাগ নদীতে স্থাপনা গড়ে উঠেছে। তা সরাতে কঠোর পদক্ষেপ দরকার।
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা বলেন, কৃষিনির্ভর অর্থনীতির কথা ভেবে নদীর সৌন্দর্য ও স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে ১৩টি নদ-নদীর বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।