মাদক-সন্ত্রাস নিয়ে এবার উঠে এলো ভয়ংকর তথ্য, নেপথ্যে ছিলেন যারা

জসিম উদ্দিন, কক্সবাজার
প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:০১ এএম

দেশে মাদক-সন্ত্রাসের বিস্তার নিয়ে দীর্ঘদিন বিস্তর আলোচনা চললেও এবার উঠে এসেছে ভয়ংকর তথ্য। অভিযোগ উঠেছে, প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশে ইয়াবার বিস্তার ঘটানো হয়েছে, যার মূল লক্ষ্য ছিল যুবসমাজকে ধ্বংস করা এবং দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়া। এ চক্রের অন্যতম সহযোগী কক্সবাজার-৪ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য ও ইয়াবা গডফাদারখ্যাত আবদুর রহমান বদি। এছাড়া আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষ নেতাও জড়িত ছিলেন।
গোয়েন্দা তথ্য, দীর্ঘ অনুসন্ধান ও স্থানীয় সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) শহিদুল হক পরিকল্পিত মাদক-সন্ত্রাসের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। এ তিনজন ইয়াবা ব্যবসা থেকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের কমিশনও নিতেন। গোয়েন্দা সংস্থা ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার পক্ষ থেকে বিষয়টি কয়েকবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানানো হলেও তিনি উলটো সংশ্লিষ্টদের ধমক দেন। এ কারণে মাদক-সন্ত্রাসে তার নীরব সম্মতি ছিল বলেই অভিযোগ উঠেছে।
এখানেই শেষ নয়। কাদের-কামালদের বিষয়ে মুখ খোলার কারণেই প্রাণ দিতে হয়েছে আত্মসমর্পণ করা ইয়াবা মাফিয়া হাজি সাইফুল আলমকে। পুলিশের ‘সেফ হোম’-এ থাকার সময় তাকে পরিকল্পিতভাবে বের করে হত্যা করা হয়। অন্যদিকে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে শত শত মানুষকে বিচারবহির্ভূতভাবে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে, অথচ প্রকৃত গডফাদাররা থেকেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদন ধামাচাপা : কক্সবাজারে কাজ করা গোয়েন্দা সংস্থার এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, মাদক কারবারে জড়িত থাকায় ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের আগে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে প্রাণপণ চেষ্টা করা হয়েছিল আবদুর রহমান বদি এবং তার স্ত্রী শাহীন আক্তার চৌধুরী যাতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পান। কিন্তু ওবায়দুল কাদের ও আসাদুজ্জামান খানের তৎপরতায় সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। বদির পরিবর্তে মনোনয়ন পান স্ত্রী শাহীন আক্তার চৌধুরী।
গোয়েন্দা তথ্য বলছে, বদির ইয়াবা ব্যবসা থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন পেতেন ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান ও শহিদুল হক। বিষয়টি নিয়ে নানা সময় গোয়েন্দা সংস্থার সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনা এলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।
টেকনাফে দায়িত্ব পালন করা দুজন সাবেক ওসি জানিয়েছেন, সীমান্ত দিয়ে যত ইয়াবা ঢুকত, তার কমিশন নিয়মিতভাবে বদি ও শীর্ষ নেতাদের কাছে পৌঁছে যেত। তারা আরও জানান, মাদক নির্মূলের নামে কয়েক শ হত্যা এবং ইয়াবাবিরোধী অভিযানগুলো ছিল কেবলই লোকদেখানো। স্থানীয় পাচারকারী এবং ছোট ডিলারদের গ্রেফতার করা হলেও আসল হোতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বারবার বাধা দেওয়া হতো।
গোয়েন্দা সংস্থার মাঠপর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা একই ধরনের তথ্য দিয়ে বলেন, উচ্চপর্যায়ের নেতাদের নাম এলেই আমরা কিছু করতে পারি না। তারা এতটাই প্রভাবশালী যে, তাদের ছায়াও আমরা স্পর্শ করতে পারি না। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, প্রতিবেশী দেশের সহযোগিতায় পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশে ইয়াবার আগ্রাসন ঘটানো হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল যুবসমাজকে ধ্বংস করা এবং দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো দুর্বল করা।
হাসিনার সম্মতিতে মাদক-সন্ত্রাস : গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে একাধিকবার সতর্ক করার পর আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে মাদক ব্যবসা নিয়ে অসন্তোষ দেখা দেয়। একদল আওয়ামী লীগ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অভিযোগ জানালে তিনি বিষয়টি আমলে না নিয়ে উলটো তাদের ধমক দেন।
সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে কক্সবাজার-৪ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে একটি দল গণভবনে গিয়ে বদির বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার ভয়াবহতা তুলে ধরে। কিন্তু শেখ হাসিনা অভিযোগটি গুরুত্ব না দিয়ে বলেন, ‘আপনাদের সময়েই তো মাদক এসেছে দেশে। এখন এত কথা বলার দরকার নেই!’ এই প্রতিনিধি দলের সঙ্গে উপস্থিত কক্সবাজার জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা সোহেল আহমেদ বাহাদুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, নেত্রী এমনটা বলবেন, কখনো ভাবিনি। মনে হয়েছে নেত্রী সবই জানেন।
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওবায়দুল কাদের বদিকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গভবনে গিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। ওই সময় বদি সরাসরি বলেছিলেন, আপা, ইয়াবা ব্যবসা সরকারের পক্ষে বন্ধ করা সম্ভব না। বরং আপনি চাইলে মাদক কারবারিদের কাছ থেকে তিনশ আসনের নির্বাচনি খরচের ব্যবস্থা করতে পারব। শেখ হাসিনা সরাসরি কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে বদিকে তার মতো কাজ চালিয়ে যেতে বলেন। একই বৈঠকে আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন বিষয়টি যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ ও সিআইডির করা তালিকায় বারবার ইয়াবা গডফাদার এবং নানা অপরাধে শীর্ষে নাম উঠে এলেও বদিতে মুগ্ধ ছিলেন হাসিনা। বিভিন্ন সময় কেন্দ্রীয় ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের মুখে এমন কথা শোনা গেছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, বদিকে কক্সবাজার জেলার আওয়ামী লীগের ম্যাজিকম্যান ও শক্তি বলে মনে করতেন শেখ হাসিনা। এমনকি কখনো সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও বদি ভোটেই নির্বাচিত হবে-এমনটা বিশ্বাস করতেন তিনি। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০১২ সাল থেকেই মূলত পরিকল্পিতভাবে দেশে মাদক-সন্ত্রাসের শুরু। এরপর ২০১৪ সালে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল ও সাবেক আইজিপি শহিদুল দায়িত্ব নেওয়ার পর এটি আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। এরপর ২০১৮ সালে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোর নাম করে নাফ নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। মূলত মাদক চোরাচালান নিরবচ্ছিন্ন করাই এর উদ্দেশ্য ছিল।
তথ্য ফাঁস করায় সাইফুলকে হত্যা : ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশে প্রথমবার ১০২ জন ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করেন। এরপর দ্বিতীয় দফায় আত্মসমর্পণের জন্য যোগাযোগ করেন সাবেক আইজিপি শহিদুল হকের ব্যবসায়িক পার্টনার হিসাবে পরিচিত এবং কয়েকবার সিআইপি মর্যাদা পাওয়া আলোচিত সাইফুল আলম। মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করেন সাংবাদিক আকরাম হোসেন। সরকারের অনুমোদন পাওয়ার পর ২০১৯ সালের ১২ মে রাত ১১টায় সাইফুল শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান। বিমানবন্দর থেকে সাইফুলকে পুলিশ গ্রহণ করে প্রথমে ঢাকার একটি অজ্ঞাত স্থানে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে তাকে কক্সবাজার পুলিশ লাইনে নিয়ে রাখা হয়। যেখানে আত্মসমর্পণের অপেক্ষায় থাকা মাদকের অন্য কারবারিদের রাখা হয়েছিল।
গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সাইফুল ইয়াবা কারবারে জড়িত অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন-ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও শহিদুল হক। এ তথ্য ফাঁস করাই সাইফুলের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৯ সালের ৩১ মে রাতে কুখ্যাত ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নেতৃত্বে পুলিশ সাইফুলকে সেফ হোম থেকে বের করে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের পর ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া থেমে যায় এবং মাদক নির্মূল উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একজন ডিআইজি প্রতিবেদককে জানান, আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশে সাইফুলকে সেদিন হত্যা করা হয়, যাতে তাদের অপকর্ম ফাঁস না হয়।
এদিকে জানা যায়, ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত শুধু ওসি প্রদীপের আমলেই টেকনাফে পুলিশের ক্রসফায়ারে ১৪৪ জন নিহত হয়েছেন।
‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’ ছিলেন বদি : দীর্ঘদিন কক্সবাজারসহ দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় ইয়াবা ব্যবসা চললেও এর প্রকৃত সুবিধাভোগী ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষপর্যায়ের কিছু প্রভাবশালী নেতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় প্রভাবশালী কর্মকর্তা। বদির ঘনিষ্ঠজন ও কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বদি শুধু একজন মধ্যস্থতাকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’, যিনি ক্ষমতার আশীর্বাদ নিয়ে সীমান্ত থেকে রাজধানী পর্যন্ত ইয়াবা সরবরাহের বিশাল চক্র নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার কমিশনের অংশ পেতেন ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান কামালসহ আরও অনেকে।
তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের বিচার জরুরি : উচ্চপর্যায়ের কেউ জড়িত না থাকলে বদিকে শাস্তির বদলে মনোনয়ন দেওয়া হতো না বলে মন্তব্য করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, এ তথ্য আমার কাছে নতুন কিছু মনে হয় না। কারণ, ইয়াবা বা মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন আবদুর রহমান বদি। তবে তিনি যে এককভাবে অপারেট করেননি, তার ভদ্র সহায়ক ও যোগসাজশকারীরা তাকে সুরক্ষাদান করেছেন। যারা উচ্চপর্যায়ে অবস্থান করছিলেন। সেটা না হলে বদিকে এভাবে সুরক্ষা দেওয়া এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও শাস্তির বদলে মনোনয়ন দেওয়া হতো না।
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, বদির সঙ্গে শুধু উচ্চপর্যায়ে থাকা ব্যক্তি নন, মাদক নির্মূলকারী ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার অনেকেই জড়িত ছিলেন। গোয়েন্দা সংস্থার অনেকেও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। আর এই লাভের অংশ একেবারে উচ্চপর্যায়ে পৌঁছানোর কারণেই রাষ্ট্রযন্ত্র মাদকের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত থাকার প্রসঙ্গে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না। তবে যেহেতু দেশের চ্যানেল হয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক দেশে মাদকের বিস্তার ঘটেছে, তাই এতে তাদের জড়িত থাকা স্বাভাবিক বিষয়। এখনো সব মাদক মাফিয়াকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব। শুধু মাদক নির্মূলের নামে নয়, প্রতিটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা জরুরি।
এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কি না জানতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
এদিকে অভিযুক্তদের মধ্যে আবদুর রহমান বদি ও শহিদুল হক কারাগারে আছেন। আর ওবায়দুল কাদের ও আসাদুজ্জামান খান কামাল আত্মগোপনে থাকায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

