Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

কুমিল্লায় নিরাপত্তা হেফাজতে যুবদল নেতার মৃত্যু

ফের বিচারবহির্ভূত হত্যা

সর্বত্র নিন্দা ও ক্ষোভ, জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি * ‘আমার স্বামী সন্ত্রাসী ছিল না, কেন তাকে এভাবে নির্যাতন করে মারা হলো?’ * সেনা ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডারকে প্রত্যাহার

Icon

কুমিল্লা ব্যুরো

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ফের বিচারবহির্ভূত হত্যা

ছবি: সংগৃহীত

যৌথবাহিনীর হেফাজতে কুমিল্লায় যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে এলাকায় তোলপাড় চলছে। ঘটনার পর থেকে নগরীতে ক্ষোভ-বিক্ষোভে উত্তাল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও এলাকাবাসী, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংগঠন হেফাজতে থাকাবস্থায় যুবদল নেতার মৃত্যুর ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছে। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পরও ফের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিস্ময় প্রকাশসহ নানামুখী প্রশ্ন তুলছেন। বলা হচ্ছে, এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটত পতিত স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের সময়ে। কিন্তু এখন আবার কেন? প্রত্যেকে এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। 

হেফাজতে মৃত্যুর শিকার তৌহিদুল ইসলামের স্ত্রী ইয়াসমিন নাহার কান্নাজড়িত কণ্ঠে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, কেন তাকে এভাবে হত্যা করা হলো? সে তো কোনো সন্ত্রাসী ছিল না। আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে শনিবার দফায় দফায় কুমিল্লা শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। এদিন দুপুরে কুমিল্লা প্রেস ক্লাবের সামনে লাশ নিয়ে বিক্ষোভ করে এলাকাবাসী।

এদিকে যুবদল নেতার মৃত্যুর ঘটনায় বিবৃতি দিয়েছে আইএসপিআর। এতে ঘটনায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার আশ্বাস দেওয়া হয়। একই সঙ্গে সেনাক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডারকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। অপরদিকে তদন্তসাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকেও পৃথক বিবৃতি দেওয়া হয়। 

সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবী ইউনিয়নের ইটাল্লা গ্রামের বাসিন্দা এবং ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক তৌহিদুল ইসলাম চট্টগ্রামের একটি শিপিং কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। গত ২৬ জানুয়ারি তার বাবা মারা যায়। ৩১ জানুয়ারি শুক্রবার বাবার কুলখানিতে অংশ নেওয়ার জন্য বাড়িতে আসেন তৌহিদুল। এলাকার লোকজন তাকে অত্যন্ত বিনয়ী হিসাবে জানে। 

নিহতের স্ত্রী ইয়াসমিন নাহার বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাতে আমার স্বামী চট্টগ্রাম থেকে আসার পর সেনাবাহিনীসহ সাদা পোশাকের কয়েকজন আমাদের বাড়িতে অভিযান চালায়। এ সময় আমার স্বামীকে তুলে নেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ রয়েছে আমরা জানতে চাইলেও কিছুই বলা হয়নি। তাকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় তাৎক্ষণিকভাবে আমরা থানাসহ আশপাশে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তার কোনো সন্ধান পাইনি।’ তিনি জানান, ‘পরদিন সকালে তাকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার করতে আমাদের বাড়িতে আবারও তল্লাশি চালানো হয়। এ সময় কোনো কিছুই পায়নি তারা। দুপুরে পুলিশের ফোন পেয়ে সদর হাসপাতালে গিয়ে তার নিথর দেহ দেখতে পাই। তারপরও চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান আরও আগেই তিনি মারা গেছেন।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার স্বামীর শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তাকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে। শরীরের প্রতিটি অঙ্গে ক্ষতের চিহ্ন রয়েছে। আমার চারটি কন্যা সন্তান রয়েছে। আমার স্বামী কোনোদিন কোনো অন্যায় কাজ করেনি। সে একটা শিপিং কোম্পানিতে চাকরি করে। আমাদের পরিবার এলাকার সবচেয়ে নিরীহ পরিবার হিসাবে পরিচিত। কিন্তু কী কারণে আমার স্বামীকে হত্যা করা হলো আমি জানি না। সে তো কোনো সন্ত্রাসী ছিল না। আমি সর্বস্বান্ত হয়ে গেলাম। আমি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের কঠোর শাস্তি দাবি করছি।’ 

নিহতের ভাই আবুল কালাম আজাদ টিপু বলেন, শুনেছি পাশের বাড়ির তানজিল ইসলামের অভিযোগের ভিত্তিতেই আমার ভাইকে তুলে নেওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের মামলা-মোকদ্দমা ছাড়া এভাবে একজন জীবিত মানুষকে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হবে এটা কোন আইন? আমরা কোন দেশে বাস করি? আমার ভাইয়ের হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।’ 

কোতোয়ালি থানার এসআই মোরশেদ আলম যুগান্তরকে বলেন, তৌহিদুল ইসলামকে আমরা গোমতী নদীর তীর থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করি। তখন তিনি কাতরাচ্ছিলেন। উদ্ধারের ৩-৪ মিনিটের মধ্যেই তিনি লুটিয়ে পড়েন। আমরা হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

থানার আরেক এসআই শাহ আমিন বলেন, তৌহিদুলের লাশের প্রাথমিক সুরতহাল আমি করেছি। তার শরীরের পেছনে কালো দাগ এবং পেটের দুটি অংশে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তাছাড়া শরীরে কয়েকটি কালো দাগ দেখা গেছে। তবে ময়নাতদন্তেই সবকিছু বেরিয়ে আসবে।

তৌহিদুলের সঙ্গে আটক লুৎফুর রহমান বলেন, ‘তৌহিদের সঙ্গে আমাকেও আটক করা হয়। তারা তৌহিদকে এমনভাবে নির্যাতন করেছে যা বর্ণনা করার মতো নয়। নির্যাতনের পর সে উঠে দাঁড়াতে পারেনি। তার ওপর নির্যাতন দেখে আমি তখনই ভেবে নিয়েছি সে আর বাঁচবে না।’ 

তৌহিদুলের ভাগনি গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর মাহবুবা উদ্দিন বলেন, ‘ঘটনার শুরু থেকে এ পর্যন্ত দফায় দফায় আমরা কুমিল্লা সেনানিবাসের সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা পুরো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের সেনা আইনে বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা যদি ন্যায়বিচার না পাই তাহলে আইনগত পদক্ষেপ নেব।’ 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কুমিল্লা মহানগর শাখার সদস্য সচিব রাশেদুল হাসান বলেন, ঘটনার পর থেকে আমরা এ বিষয়ে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি, সেনাবাহিনী জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে জনতার সঙ্গে মধুর সম্পর্ক রেখে দেশের জন্য কাজ করেছে। কিন্তু এভাবে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির মৃত্যু আমাদের কষ্ট দেয়। আশা করি ওই ব্যক্তির পরিবার এর বিচার পাবে।’

অপরদিকে তৌহিদুলকে নৃশংসভাবে হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে এলাকাবাসী। শনিবার দুপুুরে নিহতের বাড়ি থেকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে লাশ কুমিল্লা প্রেস ক্লাবে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি করা হয়। এদিন সকালে ইটাল্লা গ্রামে হাজার হাজার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামের জানাজা শেষে দাফন সম্পন্ন হয়েছে। শনিবার দুপুরে আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবী ইউনিয়নের ইটাল্লা ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা মাঠে প্রথম ও একই স্থানে আসরের নামাজের পর দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

জানাজায় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক সম্পাদক, সাবেক সংসদ-সদস্য হাজি আমিন উর রশিদ ইয়াছিন, কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, কেন্দ্রীয় যুবদল সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন, কুমিল্লা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক উদবাতুল বারী আবু, সদস্য সচিব ইউসুফ মোল্লা টিপু, মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জসীম উদ্দীন, আতাউর রহমান ছুটি, কুমিল্লা মহানগর বিএনপি নেতা নিজাম উদ্দিন কায়সার, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা যুবদলের আহ্বায়ক আনোয়ারুল হক, সদস্য সচিব ফরিদ উদ্দিন শিবলুসহ অন্য নেতারা। এ সময় সবার চোখে ছিল পানি। সৃষ্টি হয় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। 

তৌহিদুল ইসলাম জেলার আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবি ইউনিয়নের ইটাল্লা গ্রামের মৃত মোখলেছুর রহমানের ছেলে। তিনি ইউনিয়ন যুবদলের আহবায়ক ছিলেন। রাজনীতির পাশাপাশি চাকরি করতেন চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি শিপিং কোম্পানিতে। 

দ্রুত তদন্তের নির্দেশ সরকারের : নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যুর ঘটনার দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। শনিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের এক বিবৃতিতে সরকারের এই নির্দেশনার কথা জানানো হয়েছে।

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে যে কোনো ধরনের নির্যাতন ও হত্যার কঠোর নিন্দা জানায়। জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানবাধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করাই এই সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য, যেখানে দেশের শীর্ষ মানবাধিকারকর্মীরা সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে রয়েছেন।

প্রেস উইংয়ের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কুমিল্লায় গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে আহত অবস্থায় তৌহিদুল ইসলামকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। অভিযোগ অনুযায়ী, ওইদিন ভোররাতে তার বাড়ি থেকে আটক করার পর তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হন। দেশে এ ধরনের অপরাধের বিচারিক প্রক্রিয়া সংস্কারের লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে একাধিক কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশনের বেশির ভাগই তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ, অপরাধ ব্যবস্থাপনা এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব সুযোগ নির্মূল করতে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপ করবে।

আইএসপিআরের বিবৃতি 

কুমিল্লায় যৌথবাহিনীর অভিযানে বেসামরিক ব্যক্তির মৃত্যু নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। বিবৃতিতে বলা হয়, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে যুবদল নেতা তৌহিদুলকে আটক করে যৌথবাহিনী। পরে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক ঘটনাটি তদন্তে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সেনাক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডারকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়াও মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটনের জন্য উচ্চপর্যায়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সেনা আইন অনুযায়ী যথাযথভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শনিবার আইএসপিআরের সহকারী পরিচালক রাশেদুল আলম খান স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতি দেওয়া হয়।


Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম