বিনা অপরাধে ১৬ বছর অন্ধকার প্রকোষ্ঠে, বাবাকেও শেষ দেখা হয়নি সোলায়মানের
মোহাম্মাদ ফজলে রাব্বি (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৫৪ পিএম
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় গত বৃহস্পতিবার গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান হাবিলদার সোলায়মান মিয়া।
এখন তার বয়স হয়েছে ৬৪ বছর। ১৬ বছরের কারাবন্দি জীবনে হারিয়েছেন আপনজনদের, হারিয়েছেন জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলো। তবে জন্মদাতা পিতার মৃত্যু সংবাদ পান দেড় মাস পর- এ ঘটনাই জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট হয়ে আছে তার জীবনে।
গত শুক্রবার সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের কেন্দুয়াই গ্রামে গিয়ে হাবিলদার সোলায়মান মিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তার বন্দি জীবনের ইতিবৃত্ত।
হাবিলদার সোলায়মান মিয়া বলেন, টানা ১৬ বছর কারাবন্দি জীবনে জন্মদাতা পিতাকে হারিয়েছি, শেষবারের মতো বাবাকে দেখতে পারিনি, বাবার কবরে একমুঠো মাটিও দিতে পারিনি, এর চেয়ে বড় কষ্ট আমার জীবনে আর নেই। এই দীর্ঘ বন্দি জীবনে আপন তিন চাচাকে, দুই মামা ও দুই মামিকে এবং তিন চাচাতো ভাইকে হারিয়েছি।
এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন হাবিলদার সোলায়মান মিয়া।
১৯৮১ সালের আগস্ট মাসে বিডিআরের চাকরিতে যোগ দেন তিনি। চাকরি জীবনে অনেক স্বপ্ন ছিল তার। সেই স্বপ্নকে আর বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনার সময় পিলখানা সদর রাইফেল ব্যাটালিয়ানে কর্মরত ছিলেন।
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৪ মার্চ জেলে যেতে হয় সোলায়মানকে। একই বছরের আগস্টে বাবা ফজলুল হক সরদার মারা যান। বাবা মারা যাওয়ার দেড় মাস পর খবর পান সোলায়মান।
হাবিলদার সোলায়মান মিয়া বলেন, ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর বিডিআর হত্যা মামলায় আমি খালাস পাই। পরে বিস্ফোরক মামলায় আমাদের আটক দেখানো হয়। পিলখানার ঘটনার দিন আমি ভিতরে ডিউটিরত ছিলাম।
সোলায়মান বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমি বিন্দুমাত্র জড়িত নই। সেই সময় আমি নিজের জীবন বাঁচাতেই ব্যস্ত ছিলাম। বিনা অপরাধে আমাকে ১৬ বছর কাটাতে হয়েছে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় বাবার মৃত্যুর খবর জানতে পারি দেড় মাস পরে। এই বিচার কার কাছে দিব।
তিনি বলেন, আমি চাই যারা অপরাধী, তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তাদের বিচার হোক। আমিও যদি দোষী হই আমারও বিচার হোক। এখনো যারা বিনা দোষে কারাবন্দি আছে, তাদের মুক্তি দেওয়া হোক।
১৬ বছর কারা ভোগের পর মুক্তি পাওয়ায় তিনি আন্দোলনে থাকা ছাত্র-জনতা ও বর্তমান সরকার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। হারানো চাকরি ফিরে পাওয়া ও পুনর্বাসনে সরকারি সহযোগিতা কামনা করেন হাবিলদার সোলায়মান।
হাবিলদার সোলায়মান মিয়ার স্ত্রী কোহিনুর বেগম বলেন, এতগুলো বছর দুই ছেলেকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটিয়েছি। টাকার অভাবে ঠিকমত স্বামীকেও দেখতে যেতে পারি নাই। অন্যের কাছ থেকে ধারদেনা করে সংসার চলেছে। সংসারে আমার স্বামী ছাড়া উপার্জন করার মত কেউ ছিলো না। কি যে এক অন্ধকার জীবন পাড়ি দিয়েছি, তা বলে বুঝাতে পারবো না। স্বামীকে মুক্ত দেখে অনেক খুশি আমি।
সোলায়মানের ছোট ভাই ইসমাইল সরদার জানান, বর্তমান সরকারের মাধ্যমে আমার ভাই বাড়িতে এসেছে, এতে আমরা অনেক খুশি। বর্তমান সরকারের কাছে আমি দাবি জানাই, উনার চাকরি জীবনের প্রাপ্যটুকু যেন উনি বুঝে পান।
হাবিলদার সোলায়মান মিয়ার ৮০ বছরের বৃদ্ধ মা জুলেখা খাতুন ছেলেকে কাছে পেয়ে খুবই খুশি। তিনি বলেন, নামাজে বসে ছেলের মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম। ছেলেকে জীবদ্দশায় দেখতে পারব ভাবি নাই। আজ অনেক খুশি, আমার ছেলে আমার কোলে ফিরে এসেছে।