১২ বছর আগে চুরি হওয়া ছেলেকে ফিরে পেতে চান মা
বগুড়া ব্যুরো
প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:২২ পিএম
বগুড়া শহরের ক্লিনিক থেকে নার্স ও চিকিৎসকের সহায়তায় চুরি হওয়া যমজ ছেলে আহসান হাবিবকে ফিরে পেতে এক যুগ ধরে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন মা ইতালির নাগরিক তাজমিনা আক্তার। ছেলেকে না নিয়ে প্রবাসেও যেতে পারছেন না।
ছেলেকে ফিরে পেতে কয়েক দফা কারাভোগও করেছেন। নিজ সন্তানকে ছিনতাইয়ের অপরাধে তাকে জেলেও পাঠিয়েছে প্রশাসন। তিনি তার বুকের ধনকে ফিরে পেতে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
বগুড়ার গাবতলী উপজেলার শালুকগাড়ি গ্রামের ইতালি প্রবাসী হেলাল উদ্দিনের স্ত্রী তাজমিনা আক্তার লিখিতভাবে জানান, তিনি গত ২০১৩ সালের ২৮ জুলাই বগুড়া শহরের নূরানী মোড় এলাকায় আইভি ক্লিনিকে যমজ সন্তান প্রসব করেন। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের সহায়তায় তার ছেলেকে চুরি করা হয়। তাকে বলা হয়, ছেলে সন্তানটি মৃত; তাকে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
এরপর তার ছেলেকে গাবতলী উপজেলার ঈশ্বরপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেনের কাছে বিক্রি করা হয়। পরবর্তীতে উপজেলার নেপালতলি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে চুরি যাওয়া ছেলের সন্ধান পান। স্থানীয়ভাবে সালিশ করেও ছেলে ফিরে পেতে ব্যর্থ হন। নেপালতলি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের সহায়তায় গত ২০১৯ সালে বগুড়ার দ্বিতীয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন।
আদালত ডিএনএ পরীক্ষার আদেশ দেন। তাকে ২০১৯ সালের ২৫ মার্চ থেকে দুদিন কারাগারা রাখা হয়। সেখান থেকে ঢাকার কাশিমপুর কারাগারে চালান দেওয়া হয়। সাত দিন রাখার পর ডিএনএ করার পর বগুড়া কারাগারে পাঠানো হয়। বগুড়া কারাগারে একদিন থাকার পর জামিন পান।
তিন মাস পর ডিএনএ রিপোর্টে পজিটিভ আসে; কিন্তু আদালত কর্র্তৃপক্ষ ডিএনএ রিপোর্ট জালিয়াতি করে নেগেটিভ হিসেবে গ্রহণ করেন।
তাজমিনা আক্তার এর নারাজি করলে পুনরায় ডিএনএ করার জন্য ২০ হাজার টাকা জমা নেওয়া হয়। ডিএনএ করানোর জন্য গত ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি তাকে আবারো বগুড়া কারাগারে নেওয়া হয়।
পরদিন তাকে ঢাকার ডিএনএ কার্যালয়ে পাঠানো হয়। ওই কার্যালয় থেকে জানানো হয়, আগের রিপোর্ট পজিটিভ। তাকে বগুড়া কারাগারে পাঠানো হলে জামিন পান। ডিএনএর পজিটিভ রিপোর্ট আদালতে জমা দিয়ে ছেলে ফিরে পেতে আবেদন করেন; কিন্তু আদালত থেকে তাকে বাচ্চার পরিবর্তে পিটিশন ও রিপোর্ট ফেরত দেওয়া হয়।
নিরুপায় হয়ে তিনি হাইকোর্টে রিট করেন। ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর বিচারপতিরা আসামিদের বিরুদ্ধে সমন জারি করেন। এরপর ১৪ ডিসেম্বর বগুড়ার আদালতে হাজির হন। বিচারক নথিতে নেগেটিভ রিপোর্ট দাখিল করেন। পরে তার আইনজীবী ডিএনএ অফিস থেকে পজেটিভ রিপোর্ট সংগ্রহ করেন। এতেও লাভ হয়নি।
বগুড়ার দ্বিতীয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সাবেক স্পেশাল পিপি আশেকুর রহমান সুজন, আইভি ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ ও অনেকে জালিয়াতি করেছেন। আদালতের পক্ষ নিয়ে তার আইনজীবী রনি তাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে ভয়ভীতি দেখান। এছাড়া জজকোর্টের আইনজীবীকেও হুমকি দেন। তাকে না জানিয়ে হাইকোর্টে রিট মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এত হয়রানির পরও বাচ্চা ফিরে না পাওয়ায় তাজমিনা আক্তার হতাশ হয়ে পড়েন। গত বছরের ৩১ অক্টোবর বগুড়া জেলা পরিষদের সামনে থেকে চুরি করা ছেলেকে আসামির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যান। ছেলে বাসায় এক সপ্তাহ থাকার পর আসামি পক্ষের দালাল মতিয়ার রহমান, বাবলু, রফিক, ডা. আমিনুল ইসলাম, আমজাদ হোসেন লুদুর সহযোগিতায় সদর থানা পুলিশ বাচ্চাসহ তাকে (তাজমিনা) গ্রেফতার করে। এরপর সদর থানা পুলিশ তার ছেলেকে আসামিদের হাতে তুলে দেয়। পুলিশ তার বোরকা, হিজাব ও ওড়না খুলে নিয়ে সারারাত মেঝেতে রাখে।
নিজ সন্তানকে অপহরণের অপরাধে ৭ নভেম্বর তাকে আদালতের মাধ্যমে বগুড়া জেলহাজতে পাঠানো হয়। ১৫ দিন জেলে থাকার পর ১৩ নভেম্বর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মিসকেস করেন। ২০ নভেম্বর বগুড়া জেলা ও দায়রা জজ মো. শাজাহান কবির ডিএনএ রিপোর্ট দেখার পর তাকে জামিন দেন।
তাজমিনা আক্তার আরও জানান, ছেলেকে ফিরে পেতে গত ১২ বছর অনেক লড়াই সংগ্রাম করেছেন। তারা পুরো পরিবার ইতালির নাগরিক। শুধু ছেলেকে ফিরে পাওয়ার জন্য প্রবাসে যেতে পারছেন না। কয়েক দফা কারাভোগ করেছেন।
তিনি বলেন, আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে নোটিশ করেছেন। তিনি তার চুরি হওয়া সন্তান দ্রুত ফিরে পেতে প্রধান উপদেষ্টা ও জনগণের সহযোগিতা কামনা করেছেন।